অন্ধ ব্যক্তিদের কল্পনা ও স্বপ্নের বিষয়টি বেশ জটিল এবং তা মূলত নির্ভর করে দৃষ্টিহীনতার সময় এবং ব্যক্তির অভিজ্ঞতার উপর। এখানে আরও গভীরভাবে ব্যাখ্যা করা হলো:
১. মস্তিষ্কের ভূমিকা:
মস্তিষ্ক খুবই অভিযোজনশীল এবং ইন্দ্রিয়গুলোর মধ্যে তথ্য প্রক্রিয়া করার ক্ষমতা থাকে। যদিও দৃষ্টি হলো এক ধরনের সংবেদনশীল ইন্দ্রিয়, মস্তিষ্ক কেবলমাত্র দৃষ্টির ওপর নির্ভর করে না কল্পনা বা স্বপ্ন তৈরির জন্য। মস্তিষ্কে অন্যান্য ইন্দ্রিয় যেমন শ্রবণ, স্পর্শ, গন্ধ, এবং অনুভূতির তথ্য ব্যবহার করে একধরনের "মেন্টাল ইমেজ" তৈরি করতে পারে। অন্ধ ব্যক্তিদের মস্তিষ্ক সেই অভিজ্ঞতাগুলোকে ব্যবহার করে কল্পনা বা স্বপ্নের পৃথিবী তৈরি করে।
২. জন্মগতভাবে অন্ধদের কল্পনা:
জন্মগতভাবে অন্ধ ব্যক্তিরা কখনও দেখেনি, তাই তাদের মস্তিষ্ক চাক্ষুষ চিত্র তৈরি করতে অভ্যস্ত নয়। তাদের কল্পনা বা চিন্তা সম্পূর্ণ ভিন্ন হয়। তারা যেভাবে তাদের চারপাশের পৃথিবীকে অনুভব করে, সেটিই তাদের কল্পনার উপাদান। উদাহরণস্বরূপ:
শব্দ: তাদের কল্পনায় আশেপাশের শব্দ, কথা বলা, প্রাকৃতিক শব্দ ইত্যাদির উপর ভিত্তি করে ছবি তৈরি হয়।
স্পর্শ: তারা বিভিন্ন বস্তু বা প্রাণীর গঠন, মসৃণতা, খসখসে অনুভূতি কল্পনা করে। যেমন, কাঠের মসৃণ পৃষ্ঠ, লোহার ঠান্ডা অনুভূতি, কাপড়ের নরমত্ব ইত্যাদি।
গন্ধ ও স্বাদ: তারা কোনো খাবার, ফুলের সুবাস, বা বৃষ্টির মাটির গন্ধ থেকে এক ধরনের অনুভূতি তৈরি করে।
জন্মগতভাবে অন্ধ ব্যক্তিরা এসব ইন্দ্রিয়ের উপর নির্ভর করে একটি বাস্তব জগৎ তৈরি করে, যা তাদের জন্য একধরনের কল্পনার জগৎ। যদিও তারা দৃষ্টি ব্যবহার করে না, তাদের কল্পনা অন্য ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে বেশ শক্তিশালী হয়।
৩. জীবনের পরে অন্ধ হওয়া ব্যক্তিদের কল্পনা:
যারা জীবনের একটি পর্যায়ে অন্ধ হয়েছেন, তারা আগে দেখেছেন, তাই তারা ভিজ্যুয়াল স্মৃতি ধরে রাখতে পারেন।
স্বপ্নের সময়: তারা তাদের পুরনো দৃষ্টিভিত্তিক স্মৃতি থেকে ইমেজ তৈরি করতে পারেন। এমনকি অন্ধ হওয়ার পরও তাদের মস্তিষ্কে চাক্ষুষ উপাদান থেকে তৈরি স্মৃতি থাকে এবং তা স্বপ্নে প্রতিফলিত হয়। তারা হয়তো পুরনো স্মৃতির চিত্র যেমন মানুষের মুখ, স্থান, এবং প্রকৃতির দৃশ্য দেখতে পারে।
সময় ও অভিজ্ঞতার সাথে পরিবর্তন: সময়ের সাথে সাথে, দৃষ্টিশক্তির অভাবে তাদের ভিজ্যুয়াল কল্পনা কমে যেতে পারে, এবং মস্তিষ্ক অন্যান্য ইন্দ্রিয়ের উপর বেশি নির্ভরশীল হতে পারে। তখন তাদের স্বপ্নে শব্দ, স্পর্শ এবং অন্যান্য ইন্দ্রিয়মূলক অভিজ্ঞতা প্রাধান্য পায়।
৪. অন্য ইন্দ্রিয়ের শক্তিশালী ভূমিকা:
অন্ধ ব্যক্তিদের অন্যান্য ইন্দ্রিয় (শ্রবণ, স্পর্শ, গন্ধ, স্বাদ) অত্যন্ত সংবেদনশীল হয়ে ওঠে। উদাহরণস্বরূপ:
শ্রবণ: অন্ধ ব্যক্তিরা চারপাশের বিভিন্ন ধ্বনির মাত্রা, টোন এবং উচ্চতা থেকে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করতে পারে। তারা এই শব্দগুলো কল্পনায় সংযুক্ত করে তাদের অভিজ্ঞতা বা চিন্তা গঠন করতে পারে। স্বপ্নেও তারা শব্দের উপর বেশি নির্ভর করে।
স্পর্শ: তারা বস্তু, গঠন, আকার, এবং টেক্সচারের মাধ্যমে কল্পনার জগৎ তৈরি করতে পারে। ধরুন, একটি পাথরের কঠিনতা, কাপড়ের নরমত্ব, গাছের পাতার মসৃণতা থেকে একটি ছবি তারা তাদের মস্তিষ্কে তৈরি করে।
৫. স্বপ্ন এবং চেতনা:
স্বপ্নের প্রকৃতি: গবেষণায় দেখা গেছে, অন্ধ ব্যক্তিরা স্বপ্নে শব্দ, স্পর্শ, গন্ধ এবং আবেগের মতো ইন্দ্রিয় অনুভূতি অনুভব করে থাকে। তাদের স্বপ্নে চাক্ষুষ চিত্র থাকতেও পারে, তবে এটি প্রধানত নির্ভর করে তারা কখন অন্ধ হয়েছিল তার উপর। যেমন, যারা জন্মগতভাবে অন্ধ, তাদের স্বপ্নে ভিজ্যুয়াল উপাদান থাকে না, বরং তারা অন্য ইন্দ্রিয়গুলোর মাধ্যমে স্বপ্ন অনুভব করে।
গভীর অনুভূতি: যেহেতু তাদের চাক্ষুষ অভিজ্ঞতা নেই, তাই অন্ধ ব্যক্তিদের অন্যান্য ইন্দ্রিয় প্রখর হয়। তারা স্বপ্নে বা কল্পনায় অনেক বেশি শক্তিশালী এবং গভীর অনুভূতি অনুভব করে, যা সাধারণত দৃষ্টিশক্তি সম্পন্ন মানুষের তুলনায় বেশি তীব্র হতে পারে।
৬. কল্পনার জগৎ:
অন্ধ ব্যক্তিরা এমন একটি কল্পনার জগৎ তৈরি করতে পারে যা তাদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার উপর ভিত্তি করে সম্পূর্ণ আলাদা। তারা সেইসব উপাদান কল্পনা করে যা তারা শুনেছে, ছুঁয়েছে, বা অনুভব করেছে। এ ধরনের কল্পনা তাদের জন্য বাস্তব অনুভূত হয় এবং তারা সেই কল্পনায় গভীরভাবে প্রবেশ করতে সক্ষম হয়।
সংক্ষেপে:
অন্ধ ব্যক্তিদের কল্পনা এবং স্বপ্ন দেখতে কোনো বাধা নেই, যদিও তারা দৃশ্যমান চিত্র তৈরি করতে অক্ষম। তাদের কল্পনা এবং স্বপ্ন প্রধানত শ্রবণ, স্পর্শ, গন্ধ, স্বাদ এবং আবেগের উপর ভিত্তি করে গঠিত হয়। মস্তিষ্কের অসাধারণ অভিযোজন ক্ষমতার কারণে, তারা দৃষ্টিহীনতার মধ্যেও এক ধরনের সমৃদ্ধ, বহুমাত্রিক অভিজ্ঞতা এবং কল্পনার জগৎ তৈরি করতে সক্ষম।