হস্তীঘড়ি বা এলিফ্যান্ট ক্লক কী? - ScienceBee প্রশ্নোত্তর

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রশ্নোত্তর দুনিয়ায় আপনাকে স্বাগতম! প্রশ্ন-উত্তর দিয়ে জিতে নিন পুরস্কার, বিস্তারিত এখানে দেখুন।

0 টি ভোট
118 বার দেখা হয়েছে
"প্রযুক্তি" বিভাগে করেছেন (20,390 পয়েন্ট)

1 উত্তর

0 টি ভোট
করেছেন (20,390 পয়েন্ট)
আধুনিক বিজ্ঞানচর্চা বলতে গেলে ইউরোপ কেন্দ্রিক। অন্যদিকে বিজ্ঞানচর্চার শুরুর দিকে গ্রিক এবং রোমান সভ্যতার নাম পাওয়া যায়। তবে মধ্যযুগের নাম আমরা পাই না কেন? তবে কি মধ্যযুগে বিজ্ঞান অন্ধকারে নিমজ্জিত ছিল? না, আসলে মধ্যযুগে বিজ্ঞানীদের বেশিরভাগ কাজই নষ্ট হয়ে গিয়েছে। আবার অনেক কাজ হারিয়ে গিয়েছে। যার কারণে মধ্যযুগে ঘুরেফিরে আমরা হাতেগোণা কয়েকজন বিজ্ঞানীর নাম পাই। যেমন : জাবির ইবনে হাইয়াম, ইবনে আর হাইথাম, ইবনে সিনা ইত্যাদি। এত বড়ো একটা সময় ধরে বিজ্ঞান অন্ধকারে নিমজ্জিত থাকবে, এটা অসম্ভব! এই সময়টা ছিল মূলত মুসলিম বিজ্ঞানীদের স্বর্ণযুগ। একেরপর এক দুর্দান্ত আবিষ্কার - গবেষণা করেছেন তাঁরা। কিন্তু বেশিরভাগ কাজ হারিয়ে যাওয়ায়/নষ্ট হয়ে যাওয়ায় আমরা মধ্যযুগ সম্পর্কে অনেকটাই অজানা! মুসা ইবনে শাকির, হাই ইবনে ইয়াকজান, আর কিন্দি, জাবির ইবনে হাইয়ান, ইবনে আল হাইথাম, আল বিরুনী, আল রাযি, ইবনে সিনা, আল জাহরাবি, বদিউজ্জামান আল জাজারি ইত্যাদি কয়জনকে চিনি আমরা? এনারা প্রত্যেকেই মধ্যযুগে বিজ্ঞানকে আলোকিত করেছেন।

মধ্যযুগের বিজ্ঞানীদের মধ্যে অন্যতম একজন ছিলেন বদিউজ্জামান আল জাজারি। তাঁর সম্পূর্ণ নাম বদিউজ্জামান আবুল ইজ ইবনে ইসমাইল ইবনে আর-রাজাজ আল-জাজারি। তিনি ১১৩৬ সালে তৎকালীন মেসোপটেমিয়ার জাজিরা নামক এলাকায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর শৈশব-কৈশর সম্পর্কে খুব কমই জানা যায়। তিনি বিজ্ঞানের প্রতি বিশেষ অনুরাগী ছিলেন। আল জাজারি ছিলেন সে যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বহুবিদ্যাবিশারদ। তিনি ছিলেন একাধারে একজন যন্ত্র প্রকৌশলী, উদ্ভাবক, গণিতবিদ, শিল্পী ও দক্ষ কারিগর। তাঁর আবিষ্কৃত যন্ত্রগুলোর মধ্যে আছে বিভিন্ন ধরনের যান্ত্রিক ঘড়ি, দৃষ্টিনন্দন ঝর্ণা, হাত ধোয়ার যন্ত্র, পানি উত্তোলন যন্ত্র, সুরযন্ত্র, স্বয়ংক্রিয় ফটক ইত্যাদি। এমনি তিনি পানীয় পরিবেশনের জন্য একটি হিউম্যানিয়েড রোবটও বানিয়েছিলেন। তাঁর তৈরি করা দূর্গঘড়িকে অনেকেই বিশ্বের প্রথম অ্যানালগ কম্পিউটার হিসেবে উল্লেখ করেন! ১১৮১ সাল থেকে তিনি বর্তমান তুরস্কের আনাতোলিয়ার দিয়ারবাকির রাজ্যের সুলতান নাসিরুদ্দিনের দরবারের প্রধান প্রকৌশলী হিসেবে দায়িত্ব পালন শুরু করেন।

তবে সবকিছুকে ছাপিয়ে তিনি নতুন নতুন ঘড়ি আবিষ্কারের জন্য অনেক সুনাম কুড়িয়েছিলেন। তিনি পানির চাপকে ব্যবহার করে বিভিন্ন ধরণের ঘড়ি বানিয়েছিলেন। তিনি নৌকাঘড়ি, দূর্গঘড়ি, হস্তীঘড়ি, মোমঘড়ি, ময়ূরঘড়ি ইত্যাদি ঘড়ি বানিয়েছিলেন। সবগুলোর প্রিন্সিপাল একই- পানির চাপের ব্যবহার। তিনি যে শুধু আবিষ্কারই করেছেন এমন নয়, তাঁর আবিষ্কারের নিখুঁত বর্ণনা দিয়েছেন তাঁর লেখা 'Book of Knowledge of Ingenious Mechanical Devices' বইতে। এমনকি সেইসব যন্ত্র তৈরির কৌশলও বর্ণনা করেছেন! তবে তিনি যে আবিষ্কারের জন্য চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন, সেটি হচ্ছে 'হস্তীঘড়ি বা এলিফ্যান্ট ক্লক'।

কী সেই হস্তীঘড়ি?

হস্তীঘড়ি মূলত একটি বিশেষ ধরণের জলঘড়ি, যা একটি কাঠের হাতির উপর স্থাপিত। জলঘড়িতে পানির প্রবাহ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে কোনো পাত্র কতটুকু পূর্ণ হয়েছে কিংবা তা থেকে কতটুকু পানি বেরিয়ে গেছে, তা পরিমাপের মাধ্যমে সময় মাপা হয়। এটাই মূলত হস্তীঘড়ির প্রিন্সিপাল। জলঘড়ি অন্যতম প্রাচীন একটি সময় নির্ণয় পদ্ধতি। প্রায় ১৬০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে ব্যবীলন সভ্যতায় জলঘড়ির ব্যবহারের নিদর্শন পাওয়া যায়। প্রচলিত অন্যান্য জলঘড়ির তুলনায় এই হস্তীঘড়িটি ব্যতিক্রম। প্রায় ২২ ফুট(প্রায় সাড়ে ছয় মিটার) উচ্চতার ঘড়িটি একটি বিশালাকার যান্ত্রিক হাতির উপরে স্থাপিত। এটি যে শুধুমাত্র এর জটিল কার্যপ্রণালীর জন্য অনবদ্য এমন নয়, এটি নানাবিধ সংস্কৃতিকেও ধারণ করে। ঘড়িটিতে ব্যবহৃত হাতিটি হচ্ছে ভারতীয়, এর উপর রাখা কার্পেটটি পারস্যের, ড্রাগন সদৃশ সাপ দুইটি চীনের, ফিনিক্স পাখিটি মিশরের এবং পাগড়ি পরা মাহুত ও কেরাণী আরবের। অপূর্ব সুন্দর এবং জটিল কার্যপ্রণালীর এই ঘড়িটি আজও বিজ্ঞানীদের বিস্মিত করে!

কীভাবে কাজ করে এই হস্তীঘড়ি?

ঘড়িটি একটি বিশালাকার যান্ত্রিক হাতির উপরে স্থাপিত, তা আগেই উল্লেখ করেছি। হাতির পিঠের উপর একটি পাটাতন রাখা থাকে। সেখানে পেন্সিল হাতে একজন কেরাণী বসে থাকে। পাটাতনের চার কোনায় অবস্থিত চারটি স্তম্ভের উপরে একটি দুর্গ সদৃশ কাঠামো থাকে। দুর্গের উপর থাকে একটি গম্বুজ, যার উপরে বসে থাকে একটি ফিনিক্স পাখি। দুর্গের সামনের বারান্দায় বসে থাকে আরেকজন ব্যক্তি, যার দুই পাশের জানালা দিয়ে মুখ বের করে রাখে দুটি বাজপাখি। দুর্গের নিচে এবং হাতির পিঠের উপরে মাঝামাঝি স্থানে থাকে দুটি ড্রাগনের মুখ বিশিষ্ট সাপ, যারা একটি অক্ষকে কেন্দ্র করে ঘুরতে পারে। আর হাতির কাঁধের উপর বসে থাকে একজন মাহুত, যার এক হাতে থাকে একটি কুড়োল এবং অন্য হাতে থাকে  একটি লাঠি!

তবে ঘড়ির মূল কাজটি হয়ে থাকে এর হাতির পেটের ভেতরে। হাতির পেটের মধ্যে পানিপূর্ণ জলাধারের উপরে একটি পাত্র রাখা থাকে। এই পাত্রের নিচে একটি ছোটো ছিদ্র থাকে, যার মধ্যদিয়ে পাত্রের ভেতরে পানি প্রবেশ করে। ছিদ্রটি এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যেন একবার সম্পূর্ণ পাত্র ভর্তি হতে ৩০ মিনিট সময় লাগে! আর এই পাত্রের মধ্যে থাকা একটি সুতার সাথে উপরে থাকা কেরাণীর হাতে থাকা পেন্সিল যুক্ত থাকে। ফলে পাত্রে পানি প্রবেশ করার সময় পানি চাপে সুতায় টান পড়ে এবং হাতে থাকা পেন্সিলসহ কেরাণীটি ঘুরতে শুরু করে। ঘোরার সময় পেন্সিলটি গোলাকার চাকতিতে থাকা সংখ্যাগুলোকে নির্দেশ করে যার মাধ্যমে ৩০ মিনিটের মধ্যকার অতিক্রান্ত সময়গুলো বোঝা যায়!

পাত্রটি যখন সম্পূর্ণভাবে নিমজ্জিত হয়, তখন পরপর অনেকগুলো ঘটনা ঘটে। একাধিক সুতায় টান পড়ার কারণে ঘড়ির একেবারে উপরে অবস্থিত ধারক থেকে একটি বল এসে নিচের পাখায় পড়ে এবং পাখাসহ ফিনিক্স পাখিটি ঘুরতে শুরু করে। একই সময়ে ফিনিক্স পাখিটি সুমধুর স্বরে জানান দিতে থাকে যে ৩০ মিনিট অতিবাহিত হয়েছে!

এরপরে বলটি বাজপাখির ঠোঁট দিয়ে গড়িয়ে একটি একটি সাপের মুখের উপরে এসে পড়ে। বলটির ভারে তখন সাপটি নিজ অক্ষ বরাবর হেলে পড়তে থাকে। সাপের এই হেলে পড়ার কারণে পানিপূর্ণ পাত্রটি উলটে যেয়ে খালি হয়ে যায় এবং সোজা হয়ে আবার পানির উপরে উঠে আসে। তারপর বলটি সাপের মুখ থেকে একটি দানিতে এসে পড়ে তারপর মাহুতের হাতে থাকা কুড়োল এবং লাঠি উঠানামা করতে থাকে যার মাধ্যমে একটি প্রকিয়ার পরিসমাপ্তি ঘটে এবং হেলে পড়া সাপটি আগের অবস্থানে ফেরত আসে। নতুন করে আবার সবকিছু শুরু হয়।

ঘড়িটিতে সময় নির্দেশ করার জন্য দুর্গের উপরে গম্বুজে সামনের অংশে একটি অর্ধ-চন্দ্রাকৃতির চাকতি থাকে। সেখানে, ঘণ্টা নির্দেশ করার জন্য গর্ত থাকে। ৩০ মিনিট অতিবাহিত হওয়ার পর গর্তের রং অর্ধেক পরিবর্তিত হয় এবং এক ঘন্টা অতিবাহিত হওয়ার পর গর্তের রং সম্পূর্ণরূপে পরিবর্তিত হয়। এতে করে বোঝা যায় যে সূর্যোদয়ের পরে মোট কতঘণ্টা সময় অতিবাহিত হয়েছে।
 

তবে দুঃখের বিষয় হচ্ছে, আল জাজারির এই ঘড়িটি সময়ের পরিক্রমায় বেশিদিন টিকতে পারেনি, হারিয়ে গিয়েছে। তবে তাঁর লেখা বইতে পাওয়া বর্ণনা অনুযায়ী হুবহু সেই একই হস্তীঘড়ি তৈরির চেষ্টা করা হয়েছে। এর মধ্যে দুবাইয়ের 'ইবনে বতুতা' মলের ভারতীয় অংশে রাখা হস্তীঘড়িটি অন্যতম, যা সম্পূর্ণরূপে মূল নঁকশা অনুসরণ করে বানানো হয়েছে। এছাড়াও লন্ডন বিজ্ঞান জাদুঘরে এটির প্রদর্শনী করা হয়।

- হায়াত মোহাম্মাদ ইমরান আরাফাত
করেছেন (100 পয়েন্ট)
চমৎকার উত্তর দিয়েছেন।

সম্পর্কিত প্রশ্নগুচ্ছ

+4 টি ভোট
1 উত্তর 1,777 বার দেখা হয়েছে
0 টি ভোট
1 উত্তর 238 বার দেখা হয়েছে
+1 টি ভোট
2 টি উত্তর 185 বার দেখা হয়েছে
05 ডিসেম্বর 2021 "স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা" বিভাগে জিজ্ঞাসা করেছেন Ismot Rahman (28,740 পয়েন্ট)
+2 টি ভোট
1 উত্তর 198 বার দেখা হয়েছে

10,729 টি প্রশ্ন

18,374 টি উত্তর

4,730 টি মন্তব্য

242,690 জন সদস্য

63 জন অনলাইনে রয়েছে
0 জন সদস্য এবং 63 জন গেস্ট অনলাইনে
  1. akramul5556

    110 পয়েন্ট

  2. amir

    110 পয়েন্ট

  3. FrederickEus

    100 পয়েন্ট

  4. JoeyDunbabin

    100 পয়েন্ট

  5. EliTarver48

    100 পয়েন্ট

বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় উন্মুক্ত বিজ্ঞান প্রশ্নোত্তর সাইট সায়েন্স বী QnA তে আপনাকে স্বাগতম। এখানে যে কেউ প্রশ্ন, উত্তর দিতে পারে। উত্তর গ্রহণের ক্ষেত্রে অবশ্যই একাধিক সোর্স যাচাই করে নিবেন। অনেকগুলো, প্রায় ২০০+ এর উপর অনুত্তরিত প্রশ্ন থাকায় নতুন প্রশ্ন না করার এবং অনুত্তরিত প্রশ্ন গুলোর উত্তর দেওয়ার আহ্বান জানাচ্ছি। প্রতিটি উত্তরের জন্য ৪০ পয়েন্ট, যে সবচেয়ে বেশি উত্তর দিবে সে ২০০ পয়েন্ট বোনাস পাবে।


Science-bee-qna

সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় ট্যাগসমূহ

মানুষ পানি ঘুম পদার্থ - জীববিজ্ঞান এইচএসসি-উদ্ভিদবিজ্ঞান এইচএসসি-প্রাণীবিজ্ঞান পৃথিবী চোখ রোগ রাসায়নিক শরীর রক্ত আলো মোবাইল ক্ষতি চুল কী #ask চিকিৎসা পদার্থবিজ্ঞান সূর্য প্রযুক্তি স্বাস্থ্য প্রাণী বৈজ্ঞানিক মাথা গণিত মহাকাশ পার্থক্য এইচএসসি-আইসিটি #science বিজ্ঞান #biology খাওয়া গরম শীতকাল কেন #জানতে ডিম চাঁদ বৃষ্টি কারণ কাজ বিদ্যুৎ রাত রং উপকারিতা শক্তি লাল আগুন সাপ মনোবিজ্ঞান গাছ খাবার সাদা আবিষ্কার দুধ উপায় হাত মশা মাছ ঠাণ্ডা মস্তিষ্ক শব্দ ব্যাথা ভয় বাতাস স্বপ্ন তাপমাত্রা গ্রহ রসায়ন উদ্ভিদ কালো কি বিস্তারিত রঙ পা মন পাখি গ্যাস সমস্যা মেয়ে বৈশিষ্ট্য হলুদ বাচ্চা সময় ব্যথা মৃত্যু চার্জ অক্সিজেন ভাইরাস আকাশ গতি দাঁত আম হরমোন বিড়াল কান্না
...