পৃথিবীর যুগান্তকারী আবিষ্কারগুলোর মধ্যে চাকার আবিষ্কার অন্যতম। খ্রিষ্টপূর্ব ৩৫০০ সালে চাকার আবিষ্কার ছিলো এক নতুন সভ্যতার সূচনা। এর জন্য যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ হয়ে উঠে। ধীরে ধীরে চাকাওয়ালা গাড়ি থেকে মানুষ পাড়ি জমায় আকাশ-এ। উড়োজাহাজের আবিষ্কার ছিলো যোগাযোগ ব্যবস্থার আরেক ধাপ উন্নয়ন। সময়ের সাথে সাথে মানুষ অতি সাধারণ একটি উড়োজাহাজকে আরো আধুনিক করে তোলে।
কিন্তু ব্যয়বহুল হওয়ায় উড়োজাহাজ এখনো মানুষের কাছে সাধারণ গাড়ির মতো এতটা সহজলভ্য হয়নি। যার কারণে স্থলযানই মূলতঃ চলাচলের প্রধান মাধ্যম। কিন্তু বেশ কিছু কারণে দিনের পর দিন সড়ক দূর্ঘটনা বেড়েই চলেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, শুধু রাস্তায় গাড়ি দুর্ঘটনার স্বীকার হয়ে প্রতি বছর বিশ্বে প্রায় ১৩ লক্ষ ৫০ হাজার মানুষ নিহত এবং ২ কোটি থেকে ৫ কোটি মানুষ আহত হচ্ছে। ৫–২৯ বছর বয়সী শিশু ও তরুণের মৃত্যুর প্রধান কারণ হিসেবে সড়ক দুর্ঘটনাকে দায়ী করেছে সংস্থাটি।
স্পষ্টতই বুঝা যাচ্ছে শীঘ্রই এর সমাধান হওয়া প্রয়োজন। স্বচালিত বাহন ব্যবস্থা এ সমস্যার অন্যতম সমাধান হিসেবে দাবী করছে অনেক বিশ্লেষক। তবে ইভিটোল জাতীয় গাড়ি (eVTOLs – Electric vertical take-off and landing vehicles) এ সমস্যার অন্যতম সমাধান হিসেবে কাজ করবে বলে দাবী অনেকের।
বিদ্যুৎ চালিত এ গাড়িগুলো আকাশে উড়তে সক্ষম এবং উড়োজাহাজের মতো মাটিতে ল্যান্ডিং করতে সক্ষম যা অন্য যেকোনো সাধারণ গাড়ির মতো মানুষ ব্যক্তিগত বাহন হিসেবে ব্যবহার করতে পারবে। এ গাড়িগুলো সড়ক দুর্ঘটনা ছাড়াও শব্দ দূষণ এবং পরিবেশ দূষণ কমিয়ে ট্রাফিক ব্যবস্থাকে পূর্ণতা দিবে বলে আশা করা হচ্ছে।
চলুন জেনে নেয়া যাক এমনই ১০টি অসাধারণ এবং অত্যাধুনিক গাড়ি সম্পর্কে যা বদলে দিবে ভবিষ্যতের যোগাযোগ ব্যবস্থা। এ পর্বে রয়েছে ১ম ৫টি সম্পর্কে।
এয়ারবাস কোম্পানির সিটিএয়ারবাস (City Airbus):
২০১৯ এর মে মাসে একটি ফ্লাইট প্রদর্শনিতে প্রথমবারের মতো সিটিএয়ারবাস আকাশে উড়ানো হয়।এখন পর্যন্ত শতাধিক বার বিভিন্ন স্কেলে এটিকে পরীক্ষামূলকভাবে উড়ানো হয়েছে। ডিজাইনের দিক থেকে সিটিএয়ারবাস অনন্য।
গাড়িটিতে যুক্ত আছে মোট আটটি পাখা যা মোট ৮০০ কিলোওয়াট যান্ত্রিক শক্তি সম্পন্ন যা শব্দ দূষণকে ৯৫ আরপিএম পর্যন্ত নামাতে পারে এবং গাড়িকে প্রতি ঘন্টায় ৭৫ মিটার গতি দিতে পারে।
সিটিবাস মোট ৪ জন যাত্রী নিতে পারবে এবং এটি দূর থেকেই নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। এটি কোম্পানির একটি চলমান প্রজেক্টের সাথে সমন্বয় করা হবে যা মূলতঃ আকাশের ডিজিটাল ট্রাফিক ব্যবস্থাকে ঘিরে এবং এটি সকল ব্যক্তিগত আকাশযান এবং ড্রোনের জন্য আকাশে মানুষবিহীন ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা হিসেবে কাজ করবে।
হুন্ডাই এর এস-এ১ (Hyundai: S-A1):
বিখ্যাত রাইড শেয়ারিং কোম্পানি উবার এর একটি প্রজেক্ট এর অংশ হিসেবে ‘এস-এ১’-এর মূল ধারণাকে এবছর জানুয়ারিতে সবার সামনে আনা হয়; যাকে ইভিটোল বাহনের দুনিয়ায় “এয়ার ট্যাক্সি” হিসেবে ধরা হয়।
এস-এ১, সামনে একজন পাইলট ছাড়াও চারজন যাত্রী বহন করার মতো করে নকশা করা হয়েছে। তবে এটি যাত্রীর সাথে তাদের ব্যক্তিগত মালামালও বহন করতে পারবে। ভবিষ্যতে গাড়িটিকে স্বয়ংক্রিয় করার জন্য হুন্ডাই কাজ করছে। এটি সম্পূর্ণ বৈদ্যুতিক ক্ষমতা সম্পন্ন যা ঘন্টাপ্রতি ১৮০ মিটার পর্যন্ত গতিসম্পন্ন হতে পারে। সবথেকে বড় বিষয়, এটি চার্জ হতে মাত্র ৫-৭ মিনিট সময় লাগে।
হুন্ডাই এবং উবারের পার্টনারশিপ আকাশে যান ব্যবস্থাকে উন্নত করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
ক্যালটেকের উড়ন্ত এম্বুলেন্স (Caltech: Flying Ambulance):
ঢাকার মতো ঘনবসতিসম্পন্ন শহরগুলোতে ট্রাফিক জ্যামের কারণে রোগীর মৃত্যু কারো অজানা নয়।উন্নত দেশগুলোতেও যেখানে হেলিকপ্টার এম্বুলেন্স এখনো এত সাধারণ নয়, সেখানে ক্যালটেকের এই উড়ন্ত এম্বুলেন্স একটি যুগান্তকারী উদ্ভাবন।
হেলিকপ্টার আয়তনে বিশাল, ব্যয়বহুল আর প্রচণ্ড শব্দ সৃষ্টি করে। ক্যালটেকের সুন-জো চুং এবং মোরি ঘেরিবের ডেভলপকৃত এই যানটির প্রতি পাশে তিনটি রোটার এবং উড়োজাহাজের মতো দুপাশে দুটি ডানা যুক্ত ফিচারকে এর সমাধান হিসেবে মনে করা হচ্ছে।
এই প্রজেক্টের আরেকটি অংশ হলো স্বয়ংক্রিয় ফ্লাইট সিস্টেম যার মাধ্যমে এম্বুলেন্সটি বেশি উড়ন্ত বাহন ও উঁচু দালানবিশিষ্ট নিষিদ্ধ শহরগুলো এড়াতে এবং রোগীর সর্বোচ্চ নিরাপত্তার সাথে উড়তে সক্ষম হতে হবে। এই এম্বুলেন্সের পিছনে কাজ করা দলের বিশ্বাস তারা অতি দ্রুত স্বয়ংক্রিয় ফ্লাইট ব্যবস্থা করতে সক্ষম হবে কারণ এটি সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা থেকে কম জটিলতা (পথচারী কিংবা চালক এবং মানুষের প্রভাব বিহীন মাধ্যম আকাশব্যবস্থা) সম্পন্ন।
পোরশে এবং বোয়িং: ইভিটোল ধারণা (Porsche and Boing: eVTOL Concept):
ব্যাটম্যান মুভির কথা আশা করি সবার মনে আছে। মুভিটির ব্যাটম্যানের বাহনের মতোই দেখতে এই বাহনটি। গেল বছর বোয়িং, পোরশে এবং অরোরা ফ্লাইট সাইন্সেসের একত্রতায় উঠে আসে নামকরণ না করা এই ইভিটোল এর ধারণা যার কোন প্রোটোটাইপও ছিলো না।
কোম্পানিগুলো বলেছে,তারা সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে এমন একটি বিলাসবহুল বৈদ্যুতিক উড্ডয়নক্ষম একটি বাহন বানাতে যা শহরের ছোট ছোট দুরত্বে উড়ে বেড়াতে পারবে।
অরোরা ফ্লাইট সাইন্সেস কোম্পানি ইতিমধ্যে যাত্রীবহনক্ষম স্বয়ংক্রিয় ইভিটোলের প্রোটোটাইপ পরীক্ষা শুরু করে দিয়েছে বলে জানা গেছে।
রোলস-রয়েস (Rolls-Royce: eVTOL project):
বিখ্যাত গাড়ি তৈরির কোম্পানি রোলস রয়েসের কথা আমরা সবাই জানি।২০১৮ সালে কোম্পানিটি “ফার্নবরো ইন্টারন্যাশনাল এয়ারশো” নামক একটি অনুষ্ঠানে তাদের নামকরণবিহীন এই ইভিটোল প্রজেক্টের কথা জানান।
হাইব্রিড ক্ষমতা সম্পন্ন এ গাড়িটি পিছনদিকে রোলস রয়সের এম২৫০ গ্যাস টার্বাইন বহন করবে যা বিশেষভাবে নকশা করা অল্প শব্দ করা ছয়টি বৈদ্যুতিক পাখাকে ক্ষমতার জোগান দিবে। ৪-৫ জন যাত্রী বহন করতে সক্ষম গাড়িটি ঘন্টাপ্রতি ২৫০ মিটার গতি অর্জন করতে সক্ষম। সবথেকে ভাল দিক হলো, এটি পুনরায় চার্জ দেয়ার ঝামেলা নেই। পিছনে থাকা গ্যাস টার্বাইন দ্বারাই চার্জড হবে গাড়িটি।
২য় পর্বঃ মাটি থেকে আকাশ: ভবিষ্যতের সর্বাধুনিক ১০টি গাড়ি (পর্ব-২)
তন্ময় দাস/ নিজস্ব প্রতিবেদক