দিন দিন পৃথিবীতে বিদ্যুৎ চালিত প্রযুক্তি পণ্যের ব্যবহার বেড়েই চলেছে। আধুনিক সভ্যতার এই যুগে স্মার্ট ব্রাশ থেকে শুরু করে সকালে উঠে শেভ করা প্রায় প্রতিটি কাজই হচ্ছে যন্ত্রের স্পর্শে, কোনরূপ বাধা-বিপত্তি ছাড়াই। আপনার হাতে ধরে থাকা স্মার্টফোন কিংবা তাকিয়ে থাকা কম্পিউটারটিকে সচল রাখতে হচ্ছে বিদ্যুৎ এর মাধ্যমে, যা সংরক্ষণের জন্য প্রয়োজন হচ্ছে ব্যাটারি। কিন্তু ব্যবহার বৃদ্ধি পাওয়ার সাথে সাথে ব্যাটারির ব্যবহার পরবর্তী সংরক্ষণ কিংবা পুনঃব্যবহারের অভাবে তৈরী হচ্ছে মারাত্মক পরিবেশ বিপর্যয় ও ক্যান্সার সহ নানা সমস্যা।
বাণিজ্যিক ভাবে ইলেকট্রনিক কোম্পানি সনি ১৯৯১ সালে তাঁদের ক্যাম-রেকর্ডার এর জন্য সর্বপ্রথম বাজারে আনে কার্বন ব্যাটারি। কিন্তু ব্যাটারির ইতিহাস ঘাটতে হলে আমাদেরকে আরো অনেকটা পেছনে ফিরে তাকাতে হবে, ১৯৩৮ সালের ইরাকে মাটি খুঁড়তে গিয়ে প্রত্নতাত্ত্বিকরা পেলেন গোলকধাঁধাময় এক পাত্র। পাত্রের ভেতরে একটি লোহার পাত ঢুকানো এবং চারপাশে অন্য কোনো বস্তু থাকার জন্য ফাঁকা জায়গা। অনেকটা ব্যাটারির কোষের মতো। হিসেব করে জানা গেল এটি তৈরি করা হয়েছিল খ্রিস্টপূর্ব ২৫০ সালে। তখনকার দিনে ব্যাটারি দিয়ে কি কাজ করতো তা এখনো অজানাই রয়েছে।
ফিরে আসা যাক মূল কথায়, যুগের পর যুগ বিজ্ঞানীদের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে এখনকার দিনে ব্যাটারির সক্ষমতা বহুলাংশেই বৃদ্ধি পেয়েছে কিন্তু সমস্যা হলো এসব ব্যাটারির পুনঃচক্রায়ন নিয়ে। প্রতিবছর বিক্রয় হওয়া ১.৫ বিলিয়ন স্মার্টফোন এর মধ্যে মাত্র ৫% ফোনের লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারিকে পুনঃব্যবহারযোগ্য করে তোলা হচ্ছে। যা পরিবেশের জন্য প্রধান সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়াবে নিকটবর্তী কয়েক যুগ পরেই। এই সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পেতে বিজ্ঞানীরা প্রাকৃতিক পুনরায় ব্যবহারযোগ্য বস্তু দিয়ে শক্তির আধার বা ব্যাটারি তৈরীর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
সৌরশক্তি থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ সংরক্ষণ এর ক্ষেত্রে ব্যাটারির ব্যবহারে দ্বিমুখীতা দেখা দিয়েছে। কারণ একাধারে জেনারেটর কিংবা কয়লা ব্যবহার না করে বিদ্যুৎ উৎপাদন যেমনটি পরিবেশের জন্য ভালো, আবার পরক্ষণেই এই বিদ্যুৎ কে সংরক্ষণ করার ক্ষেত্রে ব্যবহৃত ব্যাটারির বর্জ্য পরিবেশের ক্ষতি করছে। তাই উৎপাদন পরবর্তী তড়িৎ সংরক্ষণের ক্ষেত্রে পুনঃনবায়নযোগ্য উৎসের জন্য বিজ্ঞানীরা কাজ করে যাচ্ছে।
এরই প্রেক্ষাপটে বেশ কয়েকটি প্রযুক্তি কিছুটা আশা জাগিয়ে তুলছে। এর অন্যতম একটি উপাদান হলো বিশ্বের বৃহত্তম ফল কাঁঠাল ও থাইল্যান্ডের তীব্র গন্ধযুক্ত ফল ডুরিয়ান। সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়ের রাসায়নিক প্রকৌশলী ভিনসেন্স গোমেজ ও তার দল খাবারের উচ্ছিষ্ট কাজে লাগানোর চেষ্টা করছে। তারা বিশ্বের তীব্রতম গন্ধযুক্ত ফল ডুরিয়ান এবং সবচেয়ে বড় ফল কাঁঠালের ফেলে দেয়া অংশ থেকে সুপার ক্যাপাসিটর বানিয়েছেন।যার মাধ্যমে স্মার্টফোন, ট্যাবলেট ও ল্যাপটপ চার্জ করা যাবে মিনিটেই।
বৈদ্যুতিক শক্তি বেশি সময় ধরে রাখার একটি বিকল্প পদ্ধতি হলো সুপার ক্যাপাসিটর। এটি মূলত একটি রিজার্ভার হিসেবে কাজ করে। দ্রুত চার্জ হয় এবং তাৎক্ষণিকভাবে বিদ্যুৎশক্তি অবমুক্ত করে। এই বৈশিষ্ট্যের ফলে ফ্ল্যাশলাইটে ক্যাপাসিটর ব্যবহার করা হয়। সাধারণ লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারিকে ৫০ বার চার্জ করলেই এর আউটপুট ভোল্টেজ এর মান বেশ কমে যায়, কিন্তু এই ক্ষেত্রে ডুরিয়ান কাঁঠাল কিংবা অন্য জৈব বস্তু থেকে তৈরী ব্যাটারিকে ১০০ বারের বেশী চার্জ করলেও মানে তেমন কোন পরিবর্তন হয়না।
সুপার ক্যাপাসিটর সাধারণত গ্রাফিন দিয়ে তৈরি করা হয়। তবে গ্রাফিনের তৈরী ক্যাপাসিটর গুলো অনেক ব্যয়বহুল। গোমেজের দল একই বৈশিষ্ট্যের বস্তু তৈরি করেছেন ডুরিয়ান এবং কাঁঠালের ফেলে দেয়া ভূতি ও খাবার অযোগ্য অংশ দিয়ে। তারা স্পোর (ক্ষুদ্র ছিদ্র) বিশিষ্ট বিশেষ কার্বন তৈরি করেছেন যার মাধ্যমে খুব সহজেই ইলেকট্রন সঞ্চালন করা সম্ভব
গবেষক দলটি কাঁঠালের মাঝখানের স্পঞ্জের মতো অংশটি প্রথমে গরম করেন, তারপর অত্যন্ত ঠাণ্ডায় শুকানো হয়। এরপর আবার সেটি ওভেনে ১৫০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় পোড়ানো হয়। তারপর পাওয়া যায় কালো, স্পোর বিশিষ্ট অত্যন্ত হালকা একটি বস্তু। এটিকেই সুপার ক্যাপাসিটরের তড়িদ্বার হিসেবে ব্যবহার করা হয়। যা গ্রাফিনের তৈরী সুপার কন্ডাকটরের সাথে টেক্কা দিতে সক্ষম!
গবেষক দলের অন্যতম সদস্য লাবনা শবনম জানিয়েছেন, এই সুপার ক্যাপাসিটরটিকে মাত্র ৩০ সেকেন্ডে চার্জ করা যায় আর এটি বিভিন্ন ডিভাইস চালানোর কাজে ব্যবহার করা সম্ভব। তিনি জানান, আপনার ফোনটি এক মিনিটের মাঝে চার্জ করতে পারাটা একটা অবিশ্বাস্য ঘটনা নিশ্চয়ই!
এই গবেষকদের এখনকার লক্ষ্য এই সুপার ক্যাপাসিটরটি নবায়নযোগ্য শক্তির উৎসের বিদ্যুৎ সঞ্চয় করার একটি টেসকই ডিভাইস হিসেবে তৈরি করা। এটি দিয়ে যানবাহন ও বসবাড়িতে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা সম্ভব হবে।
এ এন এম নাঈম/ নিজস্ব প্রতিবেদক
+1
+1
+1
+1
3
+1
+1
+1