ভোরে ঘুম থেকে উঠার পর সতেজতার জন্য, দুপুরের কর্মব্যস্ততার মাঝে একটু মানসিক শান্তির জন্য কিংবা শেষ রাত পর্যন্ত জেগে থাকার জন্য কয়েক পেয়ালা কফির বিকল্প আমাদের কাছে নেই। কিন্তু যদি বলা হয় ফেলে দেওয়া গুঁড়ানো কফিবীজ শক্তিশালী কংক্রিট তৈরিতে ব্যবহার করা যাবে?
British Coffee Association এর পরিসংখ্যান বলছে পৃথিবীজুড়ে প্রতিদিন প্রায় ২ বিলিয়ন কাপ কফি পান করা হয়। সাধারণভাবেই কফি বানানোর পর অতিরিক্ত কফিবীজগুলোর জায়গা হয় ময়লার স্তূপে। সেখানে এই অতিরিক্ত কফিবীজ ধীরে ধীরে পচে গিয়ে তৈরি করে মিথেন গ্যাস। এই মিথেন গ্যাস আবার কার্বন-ডাই-অক্সাইড এর চেয়েও ২১ গুণ বেশি প্রভাব বিস্তারকারী গ্রিনহাউজ গ্যাস।
সে অনুযায়ী শুধুমাত্র কফি পান করেই আমরা পৃথিবীর উষ্ণতা বাড়িয়ে দিচ্ছি। অস্ট্রেলিয়ান একদল গবেষক এই অতিরিক্ত গুঁড়ানো কফিবীজ(কফি বানানো শেষে ফেলে দেওয়া গুঁড়ো করা কফিবীজ) পুনরায় ব্যবহার করার চমৎকার এক পদ্ধতি আবিষ্কার করেছেন। গবেষণায় দেখা যায়, কংক্রিট তৈরির সময় বালির পরিবর্তে কিছু পরিমাণে গুঁড়ানো কফিবীজ এর ব্যবহার কংক্রিট কে আরও শক্তিশালী করে তুলে।
সাধারণত নির্মাণ শিল্পে (Construction Industry) আমরা যে বালি ব্যবহার করে থাকি তা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নদী এবং খালবিল থেকে উত্তোলন করা হয়ে থাকে যা নদীভাঙনের প্রধান কারণগুলোর মাঝে একটি। তাই বালির পরিবর্তে যদি কিছু পরিমাণ ফেলে দেওয়া কফিবীজ ব্যবহার করা যায় তবে তা পরিবেশ রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। এই বিষয়ে গবেষকরা বলেন,
“যে-সব কংক্রিট আংশিকভাবে গুড়ানো কফিবীজ দিয়ে তৈরি সেসব কংক্রিট সাধারণ কলক্রিটের চেয়ে ৩০ শতাংশ বেশি শক্তিশালী।”
Journal of Cleaner Product এ গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয়। গবেষণার জন্য গবেষকরা প্রথমে মেলবোর্ন এর বিভিন্ন কফিশপ থেকে ফেলে দেওয়া অতিরিক্ত কফিবীজ সংগ্রহ করেন এবং খুঁজে বের করেন কীভাবে এই কফিবীজ এর বিভিন্ন উপাদান কংক্রিট এর উপর প্রতিক্রিয়া দেখায় এবং তারা খুঁজে বের করেন যে বালির পরিবর্তে ১৫ শতাংশ পর্যন্ত কফিবীজের ব্যবহার কংক্রিট এর চাপ সহ্য করার ক্ষমতা বাড়াচ্ছে।
কিন্তু কীভাবে এই অতি আশ্চর্যজনক ঘটনা ঘটছে?
সাধারণ কংক্রিট গুলো আসলে একটি সিমেন্টিটিস বাইন্ডার (অর্থাৎ, সিমেন্ট, বালি এবং জল এর মিশ্রণ)। বালি, পানি এবং অন্যান্য উপাদান মিলে যে-রকম নুড়ি পাথর তৈরি হয় অনেকটা সেরকম। এই গবেষণার বিষয়ে ব্রাজিলের সাউ পাউলো বিশ্ববিদ্যালয় এর সিভিল ইঞ্জিনিয়ার হলমার সাভাস্তানো জুনিয়র (তিনি গবেষণার কাজে যুক্ত ছিলেন না) জানান,
“সিমেন্টের মিশ্রণে জল এবং অন্যান্য যৌগগুলোর মধ্যে হাইড্রেশন প্রতিক্রিয়াগুলোর একটি জটিল সিরিজ কংক্রিটকে শক্ত করতে এবং জমাট বাধতে সাহায্য করে, তবে বালিও কিছুটা ভূমিকা পালন করে। বালিসহ অন্যান্য উপাদানের সমষ্টিকে সাধারণত জড় পদার্থ হিসাবে চিহ্নিত করা হয় এবং এই হাইড্রেশন প্রতিক্রিয়াগুলোতে অংশগ্রহণ করে না।
কিন্তু তারা কংক্রিটের স্থায়িত্ব, অখণ্ডতা এবং ম্যাক্রোস্ট্রাকচারাল কর্মক্ষমতার জন্য দায়ী – তাদের মোটামুটিভাবে আমাদের দেহের কঙ্কাল উপাদানগুলোর সাথে তুলনা করা যেতে পারে।”
নতুন এই গবেষণায় দেখা যায় যে কাঁচা কফির গুঁড়ো করা বীজ কংক্রিটে ব্যবহার করা হলে তা উল্লেখযোগ্যভাবে কংক্রিটকে দুর্বল করে দেয়। কিন্তু কফি তৈরির পর ফেলে দেওয়া অতিরিক্ত গুঁড়ানো কফিবীজ কংক্রিটের মিশ্রণে রাসায়নিক দ্রব্য ছেড়ে দিতে পারে এবং রাসায়নিক হাইড্রেশন প্রতিক্রিয়া বিষাক্ত করতে পারে যা প্রাথমিক পর্যায়ে সিমেন্টিটিয়াস বাইন্ডারকে শক্ত করে তুলতে পারে।
তবে যাইহোক, পাইরোলাইসিস নামে পরিচিত একটি রাসায়নিক পদ্ধতি ব্যবহার করে দলটি এই কফি বর্জ্যের বৈশিষ্ট্যগুলোকে উন্নত করেছিলেন এবং বালির পরিবর্তে ব্যবহার উপযোগী করে তোলেন। তারা বিশেষ এই মডিফাইয়েড গুঁড়ানো কফিবীজের নাম দেন Biochar।
পাইরোলাইসিস বলতে মূলত বুঝায় কোনো মৌলকে উচ্চতাপমাত্রায় উত্তপ্ত করে (সাধারণত এই তাপমাত্রা ৬৬২ থেকে ৯৩২ ডিগ্রি ফারেনহাইট হয়ে থাকে) ছোট ছোট কণায় পরিণত করা। এই তাপীয় পদ্ধতি কফিবীজের স্থায়িত্ব বৃদ্ধি করেছে। তবে কফি বায়োচারের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কাঠামোগত সুবিধাও রয়েছে।
এই ব্যাপারে সাভাস্তানো আরও বলেছিলেন,
“কফি বায়োচার মূল বর্জ্য পদার্থের স্মৃতি ধরে রাখে অর্থাৎ এর ছিদ্রতা এবং ব্যাপ্তিযোগ্যতা তখনও বজায় থাকে এবং এই বৈশিষ্ট্যগুলো যান্ত্রিক কর্মক্ষমতা এবং ফলস্বরূপ কংক্রিটের মতো সিমেন্ট-ভিত্তিক উপকরণগুলোর স্থায়িত্বের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।”
ছিদ্রযুক্ত এই কাঠামো সিমেন্ট এবং কফির কণার মধ্যে আসঞ্জন বল বাড়ায় এবং বায়োচারের ছিদ্রের ভিতরে আর্দ্রতা আটকে যায়। এর ফলে কংক্রিট শক্ত করার জন্য দায়ী হাইড্রেশন প্রতিক্রিয়াগুলোর ধীরে ধীরে বায়োচারে আটকে যাওয়া জলকে ব্যবহার করে কংক্রিট কে আরও শক্তিশালী করে।
গবেষক দলটি গবেষণা পত্রের উপসংহার টানতে গিয়ে বলেন,
“কংক্রিটের ১৫% বালিকে ৬৬২ ডিগ্রি ফারেনহাইট তাপমাত্রায় উৎপাদিত কফি বায়োচার দিয়ে প্রতিস্থাপন করলে কংক্রিটগুলোর চাপ সহ্য করার শক্তিতে আমূল পরিবর্তন পাওয়া যায়। আমরা এখন দীর্ঘমেয়াদি কর্মক্ষমতা, জল শোষণ, ফ্রিজ-থাও প্রতিরোধ এবং বৈদ্যুতিক প্রতিরোধে সহ অন্যান্য বৈশিষ্ট্যগুলো নিয়ে গবেষণা করছি এবং এই নতুন উপাদানটি পরীক্ষামূলক ভাবে ব্যবহার করার জন্য স্থানীয় কাউন্সিলগুলোর সাথে কাজ শুরু করার চেষ্টা করছি।”
আসিফুল হাসান আসিফ / নিজস্ব প্রতিবেদক
তথ্যসূত্র: লাইভসায়েন্স, নিউ এটলাস