বাংলাদেশের সর্ব দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের উত্তর-পূর্বাংশে অবস্থিত একটি ছোট প্রবাল দ্বীপ সেন্ট মার্টিন। স্থানীয়দের কাছে এর পরিচিতি নারিকেল জিঞ্জিরা নামে। এই নীল জলরাশির দেশ, সেন্ট মার্টিনে ভ্রমণের ইচ্ছা কম-বেশি আমাদের সবারই আছে। কিন্তু সেন্ট মার্টিনের এত জনপ্রিয়তার আরেকটি কারণ আছে। এটি বাংলাদেশের একমাত্র দ্বীপ যেখানে রয়েছে প্রবালের বাস। তাই একে প্রবাল দ্বীপ নামেও ডাকা হয়। তবে মনুষ্যসৃষ্ট ও প্রাকৃতিক বিভিন্ন কারণে বর্তমানে এই প্রবাল দ্বীপ রয়েছে হুমকির মুখে, যার পেছনে বড়ো ভূমিকা রাখছে জলবায়ু পরিবর্তন।
প্রবাল এবং প্রবাল দ্বীপ কী?
প্রবাল হল অ্যান্থজোয়া শ্রেনীভূক্ত সামুদ্রিক প্রানী। এরা পলিপ সৃষ্টিতে সক্ষম। সাধারণত এরা কলোনি তৈরি করে বসবাস করে। কলোনির সমস্ত পলিপ জিনগত ভাবে অভিন্ন হয়। এরা প্রাণী, তবে জীবনের পূর্ণবয়ষ্ক অবস্থায় সাগরতলে কোন দৃঢ় তলের উপর গেড়ে বসে বাকি জীবন পার করে দেয়। প্রতিটি প্রবাল পলিপ যেখানে গেড়ে বসে সেখানে নিজের দেহের চারপাশে ক্যালসিয়াম কার্বনেট নিঃসরণের মাধ্যমে শক্ত পাথুরে খোলস বা বহিঃকঙ্কাল তৈরি করে। একটা প্রবাল পলিপের মৃত্যুর পরেও খোলসটি রয়ে যায় এবং কালক্রমে তা শক্ত হতে হতে পাথুরে প্রকৃতির হয়ে যেতে পারে। এরকম প্রবালের দেহাবশেষের উপর নতুন করে আবার প্রবাল বসতে পারে। এভাবে একটা কলোনি বহু প্রজন্ম ধরে চলার ফলে বড়সড় পাথুরে আকৃতি ধারন করে। এভাবেই তৈরি হয় বড় প্রবাল দ্বীপ।
প্রবাল দ্বীপের ঝুঁকির পেছনের কারণ:
বর্তমানে সেন্ট মার্টিনে প্রায় ৬৬ প্রকারের বিভিন্ন প্রবাল বসবাস করছে। বিশেষজ্ঞরা বাংলাদেশের প্রবাল হুমকির মুখে পড়ার পেছনে জলবায়ু পরিবর্তনকেই সবচেয়ে বেশি দায়ী করেছেন। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তন আসলে কতটা দায়ী? চলুন জেনে নিই।
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে পৃথিবীতে গ্রীন হাউজ গ্যাসের পরিমাণ দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। এই গ্রিন হাউস গ্যাসগুলো পৃথিবীকে আচ্ছাদনরূপে ঢেকে রেখে পৃথিবীপৃষ্ঠ হতে বিকিরিত তাপ কে মহাশূন্যে ফিরে যেতে বাধা দেয়। ফলে, পৃথিবীর তাপমাত্রা বেড়েই চলেছে এবং একই সাথে সমুদ্রের পানিও অধিক তাপ শোষণ করায় পানির তাপমাত্রাও বেড়ে যাচ্ছে।
প্রবালের মধ্যে জুওজ্যান্থেলি নামক একধরনের এককোষী শৈবাল বাস করে। এই শৈবাল এবং প্রবালের মধ্যে একটি নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। শৈবালগুলো সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যে খাদ্য তৈরি করে তা গ্রহণ করেই প্রবাল বেঁচে থাকে। পানির তাপমাত্রা ২৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি হলে প্রবালের দেহের পাথুরে অংশটি ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং দেহের ভিতরে অবস্থিত শৈবালগুলো বের হয়ে যায়। এমতাবস্থায় তাদের এই পারস্পারিক সহাবস্থান নষ্ট হয়ে যায় ও প্রবালগুলোর রঙ বিকৃত হয়ে সাদা হয়ে যায়। একে প্রবালের ব্লিচিং বলে। ব্লিচিং এর ফলে প্রবালের খাদ্যাভাব দেখা দেয়। ফলে কোনো কোনো সময় এদের মৃত্যু ঘটে।
গবেষণায় দেখা যায়, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সেন্ট মার্টিনের পানির তাপমাত্রা দিন দিন বাড়ছে। ফলে প্রবালের ব্লিচিং এর পরিমাণও দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে ব্লিচিং রেট ৭০ শতাংশে পৌঁছে গেছে যা আশঙ্কাজনক। এছাড়াও ঘূর্ণিঝড়, এসিড বৃষ্টি, সমুদ্রের ক্ষয় এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগও প্রবালের জন্য ক্ষতিকর।
বায়ুমণ্ডলে বিদ্যমান গ্রিন হাউজ গ্যাসগুলোর মধ্যে কার্বন ডাই অক্সাইড অন্যতম। মানুষের বিভিন্ন কর্মকান্ডের ফলে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই কার্বন ডাই অক্সাইড গ্যাস শোষণের ফলে সমুদ্রের পানির ph ক্রমাগত হ্রাস পাচ্ছে। ফলে সমুদ্রের পানির অম্লতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। পানির অম্লতা বৃদ্ধি পাওয়ায় প্রবালের দেহের গঠন দুর্বল হয়ে পড়ছে, বৃদ্ধি ব্যহত হচ্ছে।
প্রবালের হুমকি প্রতিরোধে করনীয়:
সেন্ট মার্টিনের প্রায় ৪০০০ প্রজাতির মাছ এবং ২৫ শতাংশ সামুদ্রিক প্রাণী বেঁচে থাকার জন্য ওতপ্রোতভাবে প্রবালের উপর নির্ভরশীল। তাই নিঃসন্দেহে প্রবাল বিলুপ্ত হয়ে গেলে তা সমুদ্র ও সামুদ্রিক প্রাণী গুলোর উপর বিরূপ প্রভাব ফেলবে। পাশাপাশি যে সকল মানুষ জীবিকা নির্বাহের জন্য সমুদ্রের উপর নির্ভরশীল তারাও নিজেদের জীবিকার পন্থা হারিয়ে সমস্যার মুখে পড়বেন। ইতোমধ্যে দ্বীপটিতে প্রতিদিন অনিয়ন্ত্রিত পর্যটকদের যাতায়াত, অপরিকল্পিত স্থাপনা নির্মাণ, পরিবেশ দূষণ, পর্যটকদের অসচেতনতা এবং দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণের কারণে ইকো-সিস্টেম অর্থাৎ, প্রতিবেশ ও জীব-বৈচিত্র্য ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর প্রভাব সামুদ্রিক প্রবালের উপরও পরেছে। যার ফলে, সম্প্রতি সেন্ট মার্টিনের প্রবালের সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে কমে গিয়েছে।
সেন্ট মার্টিনের সৌন্দর্য বৃদ্ধিকারক প্রবাল এদেশের অমূল্য সম্পদ, যা রক্ষা করার দায়িত্ব আমাদের সবার। যেহেতু প্রবালের হুমকির পিছনে জলবায়ু পরিবর্তন বড়ো ভূমিকা পালন করে, তাই এ বিষয়ে আমাদের ছোটো থেকে বড়ো সকলকে সচেতন হতে হবে। সেন্ট মার্টিনে অনিয়ন্ত্রিত স্থাপনা নির্মাণ বন্ধ করে নিয়মিত ও পরিকল্পিত পর্যটন শিল্প গড়ে তোলার দিকে গুরুত্ববান হলে আমরা আমদের এই প্রবাল দ্বীপের অস্তিত্ব সংকটের মুখোমুখি থেকে রক্ষা করতে পারব।
সাফিয়া নাজাত হক/ নিজস্ব প্রতিবেদক
তথ্যসূত্র: Climate Change Induced Disaster and Adaption Strategy at Coastal Region of Bangladesh: a Case Study on Saint Martin Island, 2019, National ocean service, The Daily Star, Environmental Protection Agency, Environmental Protection Agency2, Colombia Climate School, UNCC