ক্যান্সার শব্দটি বহুযুগ আগে থেকেই মানুষের একটি চরম ভয়ের জায়গা। ক্যান্সার আক্রান্ত ব্যক্তিকে শুধু শারীরিক কষ্টই দেয় না বরং এটি আক্রান্ত ব্যক্তির জন্য মানসিক পীড়ারও কারণ। ক্যান্সার এ আক্রান্ত ব্যক্তি তার রোগের জন্য নানান রকম প্রতিকূলতার মধ্যে দিন পার করতে থাকে। ক্যান্সারের জটিল চিকিৎসা পদ্ধতি অত্যধিক ব্যয়বহুল হওয়ার কারণে এই রোগ রোগীসহ তার পরিবারকে নিঃস্ব করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। পাশাপাশি এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় রোগীকে অনেক শারীরিক যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়।
তবে ক্যান্সার মানেই যে আতঙ্ক এবং কঠিন চিকিৎসা পদ্ধতি নয় এটি এবার প্রমাণ করলেন কোরিয়ান বিজ্ঞানীরা।
কোরিয়া অ্যাডভান্সড ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি (KAIST)-এর গবেষকরা এমন একটি প্রযুক্তি তৈরি করেছেন যা কোলন ক্যান্সারের কোষকে মেরে না ফেলে সেগুলোকে সুস্থ কোষে পরিবর্তন করতে সক্ষম হয়েছে। এই প্রক্রিয়া শুধু কোলন ক্যান্সার এর ক্ষেত্রে কার্যকর। বায়ো অ্যান্ড ব্রেন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক কওয়াং-হিউন চোঁ এই নতুন পদ্ধতির নেতৃত্ব দিচ্ছেন। প্রচলিত পদ্ধতিতে সাধারণত ক্ষতিকর কোষ ধ্বংস করার ওপর নির্ভর করা হয়, যা প্রায়ই মারাত্মক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া এবং পুনরায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি সৃষ্টি করে। কিন্তু নতুন পদ্ধতিতে কোলন ক্যান্সার কোষ গুলোকে রিভার্স করে সুস্থ কোষে ফিরিয়ে আনা হয়।
গবেষণার মূল বিষয়:
প্রচলিত ক্যান্সারের চিকিৎসায় কেমোথেরাপি, রেডিওথেরাপি বা সার্জারি ব্যবহার করে ক্যান্সার কোষ ধ্বংস করা হয়। যদিও এই পদ্ধতি গুলো ক্যান্সারের চিকিৎসায় কাজ করে, তবে এগুলোর প্রায়ই মারাত্মক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হয়ে থাকে। যেমন চুল পড়ে যাওয়া, বমিভাব, ক্লান্তি এবং কখনও কখনও শরীরের নানা স্বাস্থ্যকর টিস্যুর ক্ষতি হয়। গবেষক দলের একটি বিপরীতমুখী প্রস্তাব ছিল এসব ক্ষতিকর কোষগুলোকে ধ্বংস করার বদলে তাদের পুনরায় স্বাভাবিক করে তোলা।
KAIST-এর বিজ্ঞানীরা দেখিয়েছেন, ক্ষতিকর সেলগুলোকে ধ্বংস করার পরিবর্তে, তাদের জেনেটিক সুইচ বা জিনগত সংকেত পরিবর্তন করে তাদের আবার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনা সম্ভব। এই পদ্ধতি ক্যান্সারের প্রচলিত চিকিৎসা পদ্ধতির তুলনায় অনেক কম ক্ষতিকর এবং কম পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সম্পন্ন।
গবেষণার পদ্ধতি:
ক্যান্সার কোষ গঠনের প্রক্রিয়াটি অনকোজেনেসিস নামে পরিচিত। আমরা জানি ক্যান্সার হলো মাত্রাতিরিক্ত কোষ বিভাজনের ফসল। যখন একটি কোষ ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়, তখন কোষটি তার কিছু বৈশিষ্ট্য প্রকাশ পায় তা হলো অবাধ কোষ বিভাজন এবং অন্যান্য কোষ বা টিস্যুকে আক্রমণ করার ক্ষমতা। গবেষকরা লক্ষ্য করেছেন যে এই প্রক্রিয়া উল্টানো যেতে পারে যদি কোষের জেনেটিক নেটওয়ার্কে “মাস্টার সুইচ” আণবিক উপাদানগুলো চিহ্নিত করা যায়।
KAIST গবেষকরা এটা করতে একটি নতুন পদ্ধতি তৈরি করেছেন, যাকে Cancer reversion বলা হয়। এর মাধ্যমে এ কোষকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনা হয়। এটি বাস্তবায়নে তারা একটি বিশেষ কম্পিউটেশনাল পদ্ধতি ব্যবহার করেছেন, যার নাম BENEIN.
BENEIN কী?
BENEIN এর পূর্ণরূপ হলো Boolean network inference and control. এটি মূলত একটি কম্পিউটার প্রোগ্রাম, যা ক্যান্সার সেলের মধ্যে জিনগুলোর কাজ পর্যবেক্ষণ করে।
BENEIN কোষে ক্যান্সার আক্রান্ত হওয়ার পর কি কি পরিবর্তন হয়েছে সেটি চিহ্নিত করে তারপর সেটিকে বিশ্লেষণ করে মাস্টার রেগুলেটর ( এমন একটি জিন বা প্রোটিন যা অন্য জিনের কাজ নিয়ন্ত্রণ করে) চিহ্নিত করে। যেমন: MYB, HDAC2, এবং FOXA2 জিনগুলোর দমন কোলন ক্যান্সার কোষকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে পারে। এ পদ্ধতির কার্যকারিতা পরীক্ষার জন্য তারা এটি কোলন ক্যান্সার সেল লাইন এবং প্রাণী মডেলে প্রয়োগ করেছেন এবং সফল ফলাফল পেয়েছেন।
BENEIN-এর এই কার্যপ্রণালি কেবল ক্যান্সার চিকিৎসায় নয়, অন্যান্য জৈবিক প্রক্রিয়ায়ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা:
KAIST-এর এই গবেষণা চিকিৎসাবিজ্ঞানে একটি নতুন পথ দেখিয়েছে। এটি কেবল কোলন ক্যান্সারের জন্য নয়, বরং ব্রেস্ট ক্যান্সার, লিভার ক্যান্সারসহ অন্যান্য ক্যান্সারের ক্ষেত্রেও ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে সে ক্ষেত্রে আরো গবেষণার প্রয়োজন।
গবেষণায় পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ক্যান্সার চিকিৎসার এই নতুন পদ্ধতি কেবল রোগ সারানোর নয়, বরং রোগ প্রতিরোধের ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। এটি ক্যান্সার গবেষণায় একটি মাইলফলক হয়ে থাকবে।
কোরিয়ান বিজ্ঞানীদের এই আবিষ্কার চিকিৎসাবিজ্ঞানে একটি নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করেছে। ক্যান্সারের মত ক্ষতিকর কোষকে ধ্বংস না করে তা সুস্থ কোষে রূপান্তরিত করার ধারণা কেবল চিকিৎসাবিজ্ঞানে নয়, রোগীর মানসিক ও শারীরিক সুস্থতার জন্যও সহায়ক হবে। BENEIN প্রযুক্তির মাধ্যমে জিনের নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাকে চিহ্নিত ও পরিচালনা করে যে সাফল্য অর্জিত হয়েছে তা ক্যান্সার চিকিৎসার সমস্যাগুলোকে সমাধান করবে।
এই পদ্ধতির সফলতা শুধু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হ্রাসই করবে না বরং এটি রোগীকে একটি নতুন জীবন দান করবে। ভবিষ্যতে, এই গবেষণার ফলাফল অন্যান্য ধরনের ক্যান্সারের চিকিৎসায় প্রয়োগ করা সম্ভব হলে, তা চিকিৎসা বিজ্ঞানে এক নতুন সাফল্যের দিগন্ত উন্মোচন করবে।
সুমাইয়া বিনতে সেলিম / নিজস্ব প্রতিবেদক
তথ্যসূত্র: নিউজ অ্যাটলাস , ইকোনমিক টাইমস, ওনলি মাই হেলথ