প্রায় দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে বিশ্ব জুড়ে ইন্টারনেট আসক্তি শক্তিশালী ড্রাগের মত আগ্রাসী এবং আধিপত্যের এক অন্যতম মাধ্যম হয়ে উঠেছে।গুগল, ফেসবুক আর নেটফ্লিক্সের মত নব্য উদারবাদী সফটওয়্যারগুলো হয়ে উঠেছে আমাদের নিত্যসঙ্গী। আর প্রতিনিয়ত বিশ্বব্যাপি এসব ব্যবহারের সংখ্যাও জ্যামিতিক হারে বেড়ে চলেছে।
এখন আর আমরা ইন্টারনেট পূর্ববর্তী সুবর্ণ সময়ের কথা মনে করতে পারি না। যারা সেসময়টা কাটিয়ে এসেছেন, তারা জানেন যে আজকের এই প্রযুক্তির কারণে আমাদের এই পৃথিবীর অনেক কিছু বদলে গেছে কেবল একটু উন্নতির আশায়। অনেক পরিবর্তন আর অসুবিধার মাঝেও আমরা এই ভেবে খুশি যে, এখন আর কোনো জরুরী ফাইল পৃথিবীর একপ্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে পাঠানোর জন্য দিনের পর দিন অপেক্ষা করতে হয় না।
না, আমাদের আগের সময়টা খুব যে ভাল ছিল তা কিন্তু নয়, অন্তত আমরা আজকের দিনে যা সুযোগ সুবিধা ভোগ করছি সেগুলোর জন্য হলেও নয়। ইন্টারনেট আমাদের জীবনে আমূল পরিবর্তন এনে দিয়েছে একটিমাত্র বোতামের ক্লিকের মধ্য দিয়ে। যেকোন স্থানে যেকোন সময় যোগাযোগ ও বিনোদনের জন্য, আবার যেকোন ধরনের তথ্য সাথে সাথে পেয়ে যাওয়ার জন্য আমাদের একটা ক্লিকই যথেষ্ট। এর চেয়ে বেশি আর কি-ই বা আশা করি আমরা?
কিন্তু আজ ইন্টারনেট ব্যবহারের প্রায় দুই দশকেরও বেশি সময় পর আমাদের নিজেদের অবশ্যই দুটি প্রশ্ন করা উচিত –
১. ইন্টারনেটের ব্যবহার কি আমাদের সত্যিই মুক্তির সন্ধান দিয়েছে, নাকি ধীরে ধীরে তার দাসে পরিণত করছে?
২. মুক্তির এই মাধ্যমটি আধিপত্যের মাধ্যমে পরিণত হচ্ছে না তো?
একটি ভার্চুয়াল ড্রাগ:
“The Rise of Addictive Technology and the Business of Keeping Us hooked“ বিষয়ে নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং এর অধ্যাপক অ্যাডম অ্যাল্টরের এই বইটি খুবই সামঞ্জস্যপূর্ণ। তিনি বলেছিলেন যে, ইন্টারনেট একটি নতুন ধরণের ড্রাগ, যা অনিবার্য এবং ভার্চুয়াল হলেও সমান ক্ষতিকারক বস্তুতে পরিণত হয়েছে। উন্নত বিশ্বের অর্ধেকেরও বেশি লোক তাদের স্মার্টফোন, ই-মেইল, ভিডিও গেমস, ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম বা নেটফ্লিক্সে আসক্ত।
এই পণ্যগুলোর মালিকানাধীন সংস্থাগুলো ব্যবহারকারীর মানসিক আচরণ উপর দৃষ্টি আকর্ষণ করে তাদের লক্ষ্য পূরণ করে। মনস্তত্ত্ববিদেরা একে “আচরণগত আসক্তি“ বলে আখ্যা দিয়েছেন। ফলে আসক্ত ব্যাক্তির জন্য ইন্টারনেট এবং এর সাথে যুক্ত আনুষঙ্গিক বস্তুগুলো ছাড়া চলাচল অসম্ভবপর হয়ে উঠে এবং সে নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। এই ধরনের মানসিক আচরণ ব্যক্তির জীবনে বিচ্ছিন্নতা, হতাশা, অসুখী বা আর্থিক ক্ষতির মত নানাবিধ ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে।
“ড্রাগ” শব্দটি হয়তো অনেকের কাছেই অতিরিক্ত মনে হতে পারে তবে এটিই সঠিক শব্দ। আমরা যদি অনলাইন জীবন থেকে দূরে থাকি তাহলে বুঝতে পারব যে এই জিনিসটি আমাদের কিভাবে পাগল করে রেখেছে। আমাদের মধ্যে এমন অনেকেই রয়েছে যারা ঘন ঘন তাদের প্রোফাইল পিকচার পরিবর্তন করে, প্রতি ১০ মিনিট পর পর কোন না কোন পোস্টে কমেন্ট না করে তারা থাকতে পারে না, অকারণেই ঘণ্টার পর ঘণ্টা ফেসবুক স্ক্রল করে যাচ্ছে।
এটি মানবতন্ত্রের কিছু নিকৃষ্ট বৈশিষ্ট্য যেমন ভায়োরিজম এবং প্রদর্শনীবাদকে (Voyeurism and Exhibitionism) সামনে এনেছে। অন্যের নির্লিপ্ত প্রশংসা পাওয়ার জন্য, নিজেদের অভিলাষকে সন্তুষ্ট করার জন্য তারা আসক্ত হয়ে পড়ে।
নব্য উদারবাদ উপনিবেশঃ
ড্রাগটি অবশ্যই কাউকে হত্যা করে না, অন্তত সরাসরি নয়। আসলে এটিকে নিরীহ হিসাবে বিবেচনা করা যেতে পারে। তবে একটি নব্য উদারনৈতিক অর্থনীতির প্রেক্ষাপটে এই ড্রাগের প্রভাবগুলি জেনে রাখা গুরুত্বপূর্ণ।
ইন্টারনেট আসক্তি-তে আক্রান্ত ব্যক্তিরা তাদের দিনের বেশিরভাগ সময় গুগল, ফেসবুক, নেটফ্লিক্সের মত সাইটগুলোতে ব্যয় করে, তারা তাদের ধ্যান-জ্ঞান চিন্তা-ভাবনা সর্বস্ব সেখানে ব্যয় করে। ফলে এসকল সাইটের মালিকানাধীন সংস্থাগুলো ব্যবহারকারীদের এই সকল তথ্য কাজে লাগিয়ে নিজেদের অর্থ উপার্জনের পথ বাতলে বেড়ায়।
এখন আমাদের নিজেদের জিজ্ঞাসা করা উচিত যে, আমরা আমাদের নিজস্ব পছন্দের সিদ্ধান্তগুলো নিতে সত্যই স্বাধীন কিনা। আমরা বিশ্বের সাথে কীভাবে সম্পর্কযুক্ত তা কে নির্ধারণ করে? আমাদের চিন্তা নাকি তাদেরই মন মতো দেখানো বিষয়, কোনটি আসলে আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করছে? আমরা কি আসলেই স্বাধীন?
ইন্টারনেট ব্যবহারের অন্যান্য অসুবিধাগুলোর সাথে সবচেয়ে ভয়ানক যে বিষয়টি রয়েছে তা হচ্ছে তথ্যের নিরাপত্তাহীনতা। আমরা প্রতিনিয়ত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও অন্যান্য সাইটগুলোতে নিজেদের গোপন, প্রয়োজনীয় কিংবা খুব সাধারণ তথ্যগুলো কারণে অকারণে অন্যদের সাথে শেয়ার করে যায়, যা কোন না কোন তথ্য ভাণ্ডারে সর্বদাই জমা থাকছে। ফলে যেকোন সময়ই আমাদের এই ব্যক্তিগত তথ্যগুলো পাবলিকলি ছড়িয়ে পড়ার একটা সম্ভাবনা সবসময়ই থেকে যায়।
ইন্টারনেটের হাজারো অসুবিধা ও ক্ষতিকর দিকগুলো আমাদের চারপাশে জালের মত ছড়িয়ে রয়েছে। আর সেই জালের মাঝে আমরা আমাদের ব্যক্তিগত জীবন যাপনের সকল তথ্য বিলিয়ে বেড়াচ্ছি। একবারের জন্য কেউ ভেবে দেখছি না যে আমাদের নিরাপত্তা কতটুকু নিশ্চিত। এভাবেই আমরা প্রতিদিন একটু একটু করে ইন্টারনেটের দাসে পরিণত হচ্ছি। হারিয়ে ফেলছি নিজেদের ব্যক্তি সত্তাকে।