আগে আমাদের যখন প্রশ্ন করা হতো, মানব দেহ কি দিয়ে গঠিত? আমরা এককথায় উত্তর দিতাম মানব দেহের প্রতিটি অংশই বিভিন্ন ধরনের মানবকোষ দ্বারা গঠিত। কিন্তু এক গবেষণায় দেখা গেছে, একজন পরিণত মানুষের শরীরের মাত্র ৪৩ শতাংশ মানবকোষ দিয়ে গঠিত। বাকিটা আণুবীক্ষণিক কলোনিস্ট, এতে অন্তর্ভুক্ত আছে নানা অণুজীব ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক, আর্কিয়ার মতো পরজীবীর কোষ। শরীরে বিভিন্ন অংশে অবস্থিত সব অণুজীবের সংখ্যাকে একত্রে বলা হয় হিউম্যান মাইক্রোবায়োম।
মানব শরীরের এই গোপন সত্যটি আবিষ্কারের পর বিজ্ঞানীরা মনে করছেন, অ্যালার্জি রোগটি কী করে পারকিনসন্সের মতো রোগে রূপান্তরিত হয় তা এখন বুঝতে পারা সহজ হবে। ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক ইনস্টিটিউটের মাইক্রোবায়োম বিজ্ঞান বিভাগের পরিচালক অধ্যাপক রুথ লি বলেন,” আপনার শরীরটি শুধু আপনার নয়। তবে আপনার শরীরে যেসব অণুজীব আছে তারা আপনার স্বাস্থ্যের জন্য অপরিহার্য।”
তাই আপনি যতই ভালোভাবে আপনার শরীর পরিষ্কার করেন না কেন, আপনার শরীরে আণুবীক্ষণিক জীবগুলো থেকেই যায়। ক্যালিফোর্নিয়ার সান দিয়াগো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রব নাইট বিবিসিকে বলেন, “আপনি একজন মানুষের তুলনায় অনেক বেশিই অণুজীবীয়।”
তিনি আরও বলেন, “আগে মনে করা হতো মানবদেহে মানবকোষ ও মাইক্রোবায়োমের সংখ্যার অনুপাত ১০ঃ১, এখন এই অনুপাত ১ঃ১ এর চেয়েও বেশি কাছাকাছি চলে এসেছে। বর্তমান হিসেবে, আপনি যদি সব কোষ গণনা করেন, তাহলে ৪৩% পাবেন মানব কোষ।”
তবে, জেনেটিকালিও আমরা বেশ এগিয়ে গিয়েছি। একজন মানুষের শরীরের পুরো একসেট জেনেটিক ইন্সট্রাকশন সাধারণত ২০ হাজারের বেশি জিন নিয়ে গঠিত। তবে মাইক্রোবায়োমের জিনের সংখ্যা মিলে মানব শরীরের মোট জিনের সংখ্যা দাঁড়ায় দুই কোটিরও বেশি।
ক্যালটেকের অণুজীববিদ সার্কিস ম্যাজমেনিয়া বলেন, “আমাদের কেবল একটি জিনোম নয়।মাইক্রোবায়োমের জিনোমগুলোও আমাদের শরীরের গুরুত্বপূর্ণ দ্বিতীয় জিনোম হিসেবে উপস্থিত, যা আমাদের নিজস্ব কার্যকলাপ বৃদ্ধি করে।”
তিনি আরও বলেন, “আমার মতে, আমরা মানুষ হিসেবে গড়ে উঠি আমাদের নিজেদের ডিএনএ ও আমাদের মাইক্রোবায়োমের ডিএনএ সমন্বয়ে।”
ভাবতে অবাক লাগে, আমাদের শরীরে কোন ক্ষতিকর প্রভাব ছাড়াই আমরা এতো বেশি আণুবীক্ষণিক উপাদান বহন করছি।
বিজ্ঞান দ্রুতই মাইক্রোবায়োমের উন্মোচিত প্রয়োজনীয়তাগুলোর গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পারছে। মাইক্রোবায়োমগুলো আমাদের পরিপাকে, শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ, বিভিন্ন রোগ থেকে রক্ষা করাসহ অত্যাবশ্যকীয় কিছু ভিটামিনও উৎপাদনে ভুমিকা রাখে।
মাইক্রোবায়োম প্রদাহজনিত পেটের রোগ, পার্কিনসনস, ক্যান্সারের ড্রাগগুলির কাজে, এমনকি স্থূলতা, ডিপ্রেশন এবং অটিজম সহ বিভিন্ন রোগের ক্ষেত্রেও ভুমিকা রাখে।
আজ অবধি, অণুজীব গুলির সাথে আমাদের দেহ-এর সম্পর্ক বেশিরভাগ ক্ষেত্রে যুদ্ধের মতো ছিলো। কিন্তু এই ক্ষুদ্র প্রাণীগুলি আমাদের শরীরে এভাবে ভূমিকা রাখে, যা আমরা কখনই কল্পনাও করিনি। এখন মাইক্রোবায়াল জগৎ সম্পর্কে আরও বেশি চিন্তা করার নতুন উপায় পাওয়া গেলো।
তবে একজনের মাইক্রোবায়োম অন্য জনের চেয়ে ভিন্ন। এটি আপনার ডায়েট, জীবনযাত্রা, ওজন ইত্যাদি দ্বারা প্রভাবিত। সুস্থ এবং অসুস্থ মানুষের মাইক্রোবায়োম নিয়ে গবেষণা চলছে। খুব শীগ্রই মাইক্রোবগুলো ওষুধ রূপে ব্যবহৃত হবে যা bugs as drugs নামে পরিচিত।
তানজিনা সুলতানা শাহীন/ নিজস্ব প্রতিবেদক