বিশ্বব্যাপী ছড়ানো করোনা ভাইরাসের উৎপত্তির জন্য বাদুড় ও প্যানগোলিনকে সন্দেহ করা হয় যে তারা বন্য প্রাণীদের থেকে মানুষের মাঝে এই ভাইরাস গুলো ছড়াচ্ছে। কিন্তু এর পেছনে নির্বিচারে বন উজাড় করতে থাকাও অনেকাংশে দায়ী।
এটি বিশ্বের ক্রান্তীয় বনভূমিগুলোর কাছাকাছি এলাকাতে সবচেয়ে বেশি হয়ে থাকে, যেখানে ক্রমাগত বন উজাড় করার ফলে প্রাণিগুলো তাদের প্রাকৃতিক বাসস্থান হারিয়ে লোকালয়ে মানুষের সংস্পর্শে আসে। ইয়োলো ফিভার, ম্যালেরিয়া, ইবোলা- এই সমস্ত ভাইরাস বনের সীমান্ত এলাকায় এক প্রজাতি থেকে অন্য প্রজাতিতে ছড়িয়েছে।
ডাক্তার ও জীববিজ্ঞানীদের মাঝে এসব ভাইরাসজনিত রোগ বিশেষজ্ঞরা আফ্রিকা, এশিয়া এবং আমেরিকাতে এইসব এলাকা ও অন্যান্য সংক্রমিত এলাকা নিয়ে গবেষণা করে দেখেছেন, বনভূমি ধ্বংস করা হচ্ছে-হয়েছে এমন সবজায়গাতেই এটি একটি সাধারণ সমস্যা।
পৃথিবীর অর্ধেকেরও বেশি ক্রান্তীয় বনভূমি থেকে চারটি পণ্য পাওয়া যায়: মাংস, সয়াবিন, পাম ওয়েল এবং কাঠের আসবাবপত্র। এই পণ্য গুলোর জন্য জীববৈচিত্র্যপূর্ণ ক্রান্তীয় বনগুলো ফসলের জমি এবং চারণভূমি হিসেবে প্রতিস্থাপিত হচ্ছে। যখন মানুষ অবৈধভাবে বনভূমিতে বসবাস শুরু করে তখন মানুষ ও প্রাণীদের কাছাকাছি আসার সম্ভাবনাও বৃদ্ধি পায়।
ইয়োলো ফিভারঃ বানর, মানুষ এবং ক্ষুধার্ত মশা
ইয়োলো ফিভার হল মশার মাধ্যমে ছড়ানো একটা রোগ যা ১৯ শতকে পানামা খাল এলাকায় ব্যাপক হারে ছড়িয়েছিলো। যদিও ইয়োলো ফিভার এর ভ্যাকসিন ১৯৩০ এর দশক থেকেই পাওয়া যায়, তবুও প্রতি বছর ২লক্ষ মানুষ আক্রান্ত হয় এর দ্বারা, যার এক তৃতীয়াংশ মারা যায় এবং তাদের বেশির ভাগই পশ্চিম আফ্রিকার।
এই ভাইরাস মূলত প্রাইমেট দের মধ্যে থাকে আর মানুষ যখন এদের কাছাকাছি বসবাস করে তখন মশার মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।
১৯৯০ দশকের প্রথম দিকে ইয়োলো ফিভারের প্রথম প্রকাশ কেনিয়ার কাইরো ভ্যালিতে পাওয়া যায় যেখানে বন উজাড় করার কারণে বনভুমি খন্ড খন্ড হয়ে গিয়েছিল। ২০১৬ এবং ২০১৮ এর মধ্যে দক্ষিন আমেরিকা তাদের ইতিহাসের সবচেয়ে বেশি সংখ্যক ইয়োলা ফিভার সংক্রমণ লক্ষ্য করে যাতে আক্রান্তের সংখ্যা ছিলো ২০০০ এর বেশি এবং শতাধিক মানুষের মৃত্য হয়। প্রাইমেটদের ঘনত্বের উপর করা একটি গবেষণায় দেখা যায় বনভূমি কমে যাওয়া প্রাইমেটদের ঘনবসতি বৃদ্ধির কারণ, যার ফলে রোগজীবাণুগুলি আরও ব্যাপক ভাবে ছড়িয়ে পড়ে।
ম্যালেরিয়াঃ মানুষ থেকে সংক্রমিত হতে পারে বন্যপ্রাণী
যেমন বন্যপ্রাণী থেকে মানুষের মধ্যে সংক্রমণ ঘটতে পারে তেমন মানুষ বন্যপ্রাণীতে সংক্রমণ ছড়াতে পারে। ফ্যালসিপারাম ম্যালেরিয়া প্রতি বছর হাজারো মানুষের মৃত্যুর কারণ হয় বিশেষত আফ্রিকায়। কিন্তু ব্রাজিলের আটলান্টিক ক্রান্তীয় বনভূমিতে এ রোগের আশ্চর্য্যজনক উচ্চ হার মানুষের অনুপস্থিতিতেই ছিল। মানুষের কাছাকাছি বসবাসকারী কোনো এক বানর প্রজাতি থেকে ক্রস ইনফেকশনের ফলে নতুন এলাকার বানরের মধ্যে এর বিস্তার ঘটেছে, এমনটাই ধারণা করছেন গবেষকগণ।
বিজ্ঞানীরা অ্যামাজনে বন উজাড় এবং ম্যালেরিয়ার মধ্যকার সংযোগগুলি ব্যাপকভাবে ডকুমেন্টেড করেছেন যা দেখায় কীভাবে ম্যালেরিয়াবাহী মশা এবং মানুষের মধ্যে হওয়া ম্যালেরিয়ার ঘটনাগুলোর মধ্যে বননিধনের একটা শক্তিশালী যোগসুত্র আছে।
আরেক প্রজাতির ম্যালেরিয়া Plasmodium knowlesi যা বানরের শরীরে পাওয়া যেত বলে জানা যায়, এটা এক যুগ আগে দক্ষিণ এশিয়ার মানুষের স্বাস্থ্য ঝুঁকির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। অনেকগুলো গবেষণায় দেখা যায়, যেসব এলাকায় বন নিধনের হার বেশি সেসব এলাকাতে মানুষের মধ্যে সংক্রমণের হারও অনেক বেশি।
ভেনিজুয়েলান ইকুইন ইনসেপহালটিসঃ
ভেনিজুয়েলান ইকুইন ইনসেপহালটিস আরেকটা মশা থেকে জন্ম নেওয়া ভাইরাস যেটা হাজারো মানুষের জ্বর জ্বর অসুখ এর জন্য দ্বায়ী। এর তীব্র সংক্রমণ মস্তিষ্কপ্রদাহের দিকে নিয়ে যায় এবং অনেক সময় মৃত্যুর দিকেও।
পানামার ডারিয়ান প্রদেশে বিজ্ঞানীরা দুটি ইঁদুর প্রজাতির তীক্ষ্ণদাঁতযুক্ত প্রাণি পেয়েছেন যাদের এই রোগটি আছে, যা বিজ্ঞানীদের এই সন্দেহ পতিত করেছে যে, এই প্রজাতির প্রাণি হতে পারে প্রাথমিক ধারক। হান্টা ভাইরাস, মাদাগাস্কার ভাইরাসের ধারক হিসেবেও এই প্রাণি গুলো স্বীকৃত।
ইবোলাঃ বনের প্রান্তের ভাইরাস
ইবোলার প্রথম সন্ধান পাওয়া যায় ১৯৭৬ সালে কিন্তু এর সংক্রমণ খুব সাম্প্রতিক একটি ঘটনা। ২০১৪-১৬ সালে এই সংক্রমণ পশ্চিম আফ্রিকার দেশগুলোতে ১১ হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যুর কারণ এবং এরপর বনপ্রাণী থেকে মানুষের মধ্যে ছড়ানোর বিষয়টা বিশেষ ভাবে নজরে আসে। বনভূমি খন্ড হয়ে যাওয়ায় অন্যান্য প্রাণিদের মাধ্যমে ভাইরাসটি বিস্তৃত এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছে বলে মনে করা হয় যা পরবর্তীতে বনের প্রান্তে বসবাসকারী মানুষের মাঝেও ছড়িয়েছে।
তবে করোনা ভাইরাস?
SARS-CoV-2 এর সংক্রমণের উৎস এখনও প্রমাণিত নয় তবে এর সাথে জেনেটিক্যালি মিল সম্পন্ন আরেকটি ভাইরাস বাদুড় এবং প্যানগোলিনের মধ্যে দেখা গিয়েছে।
প্যানগোলিন হল একটি খুবই বিপন্ন প্রজাতির প্রাণী যা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বনাঞ্চলে বাদুড়ের সাথে থাকে এবং পোক্ত গাছের কুঠুরীতে বসবাস করে।
প্রকৃতপক্ষে, মালয়েশিয়ায় ছোট শহুরে বনভূমিতে, প্যানগোলিন শনাক্ত করা হয়েছিল যা থেকে বিজ্ঞানীরা ধারণা করেন এই প্রাণিটি খন্ডিত বনভূমিতে থাকতে সক্ষম। ফলে এটি মানুষ বা অন্যান্য প্রাণিদের সাথে যোগাযোগ বৃদ্ধি করতে পারে ও বাদুড় প্রজাতির মত একই ভাইরাস গুলোর ধারক ও বাহক হতে পারে। প্যানগোলিনের মাংস, ত্বক এবং আঁশ অবৈধভাবে বিক্রি করা হয় এবং মালয়েশিয়া ও ভিয়েতনাম থেকে চীনে অবৈধভাবে আমদানিও করা হয়। উহানের একটি মাছের বাজার, যেখানে এই ধরনের প্রাণিদের বিক্রি করা হতো, তাকেই বর্তমান মহামারীর উৎস হিসাবে সন্দেহ করা হয়েছে।
প্রতিরোধ করার উপায়
এখানে আরও অনেক কিছু রয়েছে যার ব্যাপারে আমরা জানি না যে, কীভাবে ভাইরাস বন্য প্রাণী থেকে মানুষের মধ্যে ছড়ায় এবং কীভাবে যোগাযোগ স্থাপন ঘটে।
বনভূমির খন্ডিত অংশ এবং তাদের আশেপাশের প্রাকৃতিক স্থানগুলো কৃষিক্ষেত্র এবং চারণভূমিতে রুপান্তর হওয়া ক্রান্তীয় বনভূমির ক্ষেত্রে একটা সাধারণ দৃশ্য হয়ে গেছে। ফলে কিছু প্রজাতি হারিয়ে যায় বন ধ্বংস হওয়ার সাথে, আবার কিছু বেঁচে থাকার জন্য খাপ খাইয়ে নেয় পরিবেশের সাথে। যারা খাপ খাইয়ে নিতে পারে তারা আগের চেয়েও বেশি গভীরভাবেই পরিবেশের সাথে মিশে যায় ফলে তাদের মাধ্যমে সংক্রমণের হারও দ্রুত হয়।
এই তথ্য-প্রমাণের দ্বারা এটি স্পষ্ট যে ক্রান্তীয় বন রক্ষার সাথে সাথে বন্যপ্রাণি সংরক্ষণও করতে হবে, যেন তাদের ভাইরাসগুলোকে ছড়াতে না পারে এবং জোনোটিক স্পিলওভার প্রতিরোধ করতে হবে যা শেষ পর্যন্ত মানুষকেই সবচেয়ে বেশি উপকৃত করবে।
রওনক শাহরিয়ার/ নিজস্ব প্রতিবেদক