মানবদেহ প্রকৃতির এক আশ্চর্য সৃষ্টি। তবে বিভিন্ন রোগ আঘাত বা বার্ধক্য জনিত কারণে শরীরের কোষ ও টিস্যু ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এই ক্ষয়ক্ষতি পুনরুদ্ধার অথবা নতুন কোষ তৈরি করার ক্ষেত্রে চিকিৎসা বিজ্ঞানের নতুন আবিষ্কার হলো Stem cell therapy। স্টেম সেল হলো এমন এক ধরনের কোষ যা থেকে দেহের প্রায় সব ধরনের কোষ তৈরি করা সম্ভব।
এই চিকিৎসা পদ্ধতি চিকিৎসাবিজ্ঞানে নতুন আশা দেখিয়েছে। এটি পারকিনসন, ক্যান্সার, ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, চোখের সমস্যার মতো জটিল রোগের চিকিৎসার ব্যবস্থা করছে। তবে, বর্তমানে এটি এখন শুধু গবেষণার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয় বরং এটি ধীরে ধীরে বাস্তব চিকিৎসা পদ্ধতিতে রূপ নিচ্ছে। উন্নত গবেষণা ও ক্লিনিকাল ট্রায়ালের মাধ্যমে এই থেরাপি ভবিষ্যতে মানবজীবনকে আরও সহজ ও দীর্ঘস্থায়ী করতে পারে বলে বিজ্ঞানীরা মনে করেন।
গবেষণার শুরু
অ্যান্ড্রু ক্যাসি তার জীবনের দীর্ঘ সময় টেলিকমিউনিকেশন গবেষণায় কাজ করেন। ২০১০ সালে তাঁর পারকিনসন রোগ ধরা পড়ে। এর জন্য তাঁকে তাঁর কাজ থেকে অবসর নিতে হয়। নিজের রোগ সম্পর্কে জানার কৌতূহল থেকেই তিনি স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে ক্লিনিকাল ট্রায়ালে অংশ নেয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
২০২৪ সালে তিনি ক্লিনিকাল ট্রায়ালে অংশগ্রহণের গ্রহণযোগ্যতা পান। অক্টোবরে, সুইডেনের লুন্ড শহরের সার্জনরা তাঁর মস্তিষ্কে ভ্রূণীয় স্টেম সেল (ES) স্থাপন করেন। এই কোষগুলো তাঁর ক্ষতিগ্রস্ত টিস্যু প্রতিস্থাপন করতে পারে বলে আশা করা হয়।
এই গবেষণাটির বর্তমানে ১০০টিরও বেশি ক্লিনিকাল ট্রায়াল হয়েছে। এগুলো মূলত ক্যান্সার, ডায়াবেটিস, মৃগী, হৃদরোগ এবং চোখের বিভিন্ন রোগের চিকিৎসায় নতুন সম্ভাবনা নিয়ে এসেছে। এই থেরাপিটি অন্যান্য অনেক অনুমোদনহীন চিকিৎসা পদ্ধতি থেকে আলাদা যা অনেক সন্দেহজনক ক্লিনিকে দেওয়া হয়, যারা এমন স্টেম সেল ব্যবহার করে যেটি টিস্যুতে রূপান্তরিত হতে পারে না।
বর্তমানে বেশিরভাগ ট্রায়ালগুলো ছোট আকারে হচ্ছে এবং সেগুলো নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দিকে মনোযোগ দিচ্ছে। তবে এই পরীক্ষাগুলোর মধ্যেও জটিলতা রয়েছে। যেমন—কোন সেল কোন কাজের জন্য উপকারী হবে সেটি খুঁজে বের করা এবং শরীর যাতে সেই কোষগুলোকে প্রত্যাখান না করে সেজন্য দীর্ঘমেয়াদি ওষুধের বিকল্প খুঁজে বের করা প্রয়োজন। কেননা দীর্ঘমেয়াদি ঔষধগুলো অনেক ব্যয়বহুল পাশাপাশি এই চিকিৎসা রোগীকে শারীরিক কষ্ট দিয়ে থাকে।
স্টেম সেল থেরাপির নতুন যুগ
গত কয়েক যুগ ধরে গবেষণার মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা স্টেম সেলের নিরাপত্তা ও কার্যকারিতা প্রমাণের চেষ্টা করছেন। ফলে এখন এ থেরাপি ক্লিনিকে পরীক্ষার পর্যায়ে পৌঁছেছে।
“এই অগ্রগতির হার উল্লেখযোগ্য”
বলেছেন স্টেম সেল গবেষক মার্টিন পেরা। তিনি আরও বলেন,
“মানুষের স্টেম সেল চাষ করার মাত্র ২৬ বছর পার হয়েছে ।“
গবেষণকরা আশা করছেন স্টেম সেল থেরাপি খুব শীঘ্রই ক্লিনিকে আসবে, কিন্তু এই চিকিৎসা কিছু শর্ত সাপেক্ষে নিতে হবে। আগামী ৫-১০ বছরের মধ্যে এটি সাধারণ চিকিৎসার অংশ হয়ে উঠবে বলে আশা করা যায়।
পারকিনসনের জন্য স্টেম সেল থেরাপি
ক্যাসির পারকিনসনের লক্ষণ শুরু হয়েছিল মাত্র ৪৪ বছর বয়সে। পারকিনসন রোগে মস্তিষ্কের এক অংশে ডোপামিন উৎপাদনকারী কোষ নষ্ট হয়ে যায়। কিছু ঔষধ এই ডোপামিন কোষ পুনরুৎপাদন করতে পারলেও, এর পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া অনেক। আবার এই রোগ বাড়তে থাকলে এর ঔষধ এর কার্যকারিতা কমে যায় এবং পার্শ্ব প্রতিক্রিয়াগুলো আরো খারাপ হয় ।
ডোপামিন প্রতিস্থাপন একটি পুরাতন প্রক্রিয়া। ১৯৮৭ সালে প্রথম গর্ভপাত থেকে প্রাপ্ত ভ্রূণের মস্তিষ্কের স্নায়ু কোষ ব্যবহার করে ডোপামিন প্রতিস্থাপন করা হয়। ৪০০ এর বেশি মানুষ এটি গ্রহণ করেন। অনেকেই এটি প্রত্যাখ্যান করেন ধর্মীয় নীতিমালার কারণে। কিন্তু বর্তমানে এই চিকিৎসা পদ্ধতিটি বেশ উন্নত হয়েছে। এখন গবেষকরা ইনডিউসড প্লুরিপোটেন্ট (Ips) নামক প্রাপ্ত বয়স্ক স্টেম সেল এবং নিয়ন্ত্রিত উৎস থেকে প্রাপ্ত ভ্রূণীয় স্টেম সেল ব্যবহার করছেন। ভ্রূণীয় স্টেম সেল যা ES সেল নামে পরিচিত, এটি বিকাশের সময় অন্যান্য অনেক বিশেষায়িত কোষে রূপান্তরিত হতে পারে। যেমন – মস্তিষ্ক, হৃদপিণ্ড, ফুসফুস ইত্যাদি।
২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত, Ips এবং Es সেল নিয়ে ১১৬টি ক্লিনিকাল ট্রায়াল অনুমোদিত হয়েছে। পারকিনসনের জন্য ক্যাসি যে ট্রায়ালে অংশ নেন সেটিতে বার্কার নামক বিজ্ঞানী নেতৃত্ব দেন। এটি ব্লু রক থেরাটিউটিস নামক বায়োটেক কোম্পানি পরিচালনা করেন। এই ট্রায়ালে Es সেল থেকে প্রাপ্ত জেনেটর রোগীদের দেয়া হয়েছে। এই ট্রায়ালের প্রাথমিক ফলাফলে দেখা গেছে, এটি নিরাপদ এবং উচ্চ মাত্রার কোষ পেলে রোগীদের ক্ষেত্রে কার্যকারিতা দেখায়।
পারকিনসন রোগে মস্তিষ্কে স্টেম সেল স্থাপনে বিশেষ সুবিধা-
পারকিনসন রোগের জন্য স্টেম সেল সাধারণত মস্তিষ্কে প্রতিস্থাপন করা হয়। স্টেম সেল চিকিৎসায় অন্যান্য অঙ্গ যেমন – হৃদপিণ্ড, কিডনির তুলনায় মস্তিষ্ক তুলনামূলকভাবে সহজ প্রতিক্রিয়া প্রদান করে। আমাদের শরীরে বাইরের কোন কিছু প্রবেশ করলে আমাদের ইমিউনোসিস্টেম সক্রিয় হয়ে সেগুলোকে ধ্বংস করে। কিন্তু মস্তিষ্কের এ ক্ষেত্রে ভিন্ন প্রতিক্রিয়া প্রদান করে। মস্তিষ্কে Es cell স্থাপন করলে এটি খুব সহজেই তা গ্রহণ করতে পারে। পারকিনসন ট্রায়ালে রোগীকে ১ বছর পর্যন্ত ইমিউনোসপ্রেসেন্ট দেওয়া হয় । তারপর রোগীকে আর কোন ঔষুধ গ্রহণ করতে হয় না। মস্তিষ্ক ছাড়া অন্য অঙ্গের ট্রায়ালে সাধারণত রোগীকে সারাজীবনের জন্য ঔষুধ গ্রহণ করতে হয়। পারকিনসন ছাড়াও অন্যান্য অনেক রোগের ক্লিনিকাল ট্রায়ালে স্টেম সেল ব্যবহার করা হয়েছে। এই ট্রায়ালে গুলো অনেক সাফল্যও অর্জন করেছে। তবে এগুলো নিয়ে এখনো গবেষণা চলছে।
মৃগীরোগে স্টেম সেল
সান ফ্রান্সিসকোর নিউরোনা নামক একটি neurotherapist সংস্থা মৃগী রোগীদের মধ্যে স্টেম সেল প্রতিস্থাপন করেছে। এক বছর পর দেখা গেছে, অংশগ্রহণকারীদের অনেকেরই খিঁচুনির হার কমে গিয়েছে এবং প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছে।
এছাড়াও কর্ণিয়া এবং চোখের অন্যান্য রোগে স্টেম সেল ব্যবহারের ২৯টি ক্লিনিকাল ট্রায়াল অনুমোদিত হয়েছে।
ডায়াবেটিসের ক্ষেত্রে স্টেম সেল
বস্টনের ভার্টেক্স ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানির গবেষণায় দেখা গিয়েছে, ডায়াবেটিস রোগীর জন্য স্টেম সেলের মাধ্যমে ইন্সুলিন উৎপাদনকারী কোষ প্রতিস্থাপন করা হচ্ছে। পরীক্ষায় দেখা গেছে, ১২ জনের মধ্যে ৯ জনকে আর ইনসুলিন নিতে হচ্ছে না। ফলে রোগীকে আর পূর্বের মতো দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসার মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে না।
হৃদরোগের জন্য
হৃদপিণ্ড হচ্ছে মানব দেহের সবচেয়ে জটিল অঙ্গ। হৃদপিণ্ডে কোষ প্রতিস্থাপন করা অনেক কঠিন। যদিও গবেষণা চলছে, তবে বড় ক্ষত ও ফ্যাট জমে থাকা হৃদপিণ্ডের ক্ষেত্রে প্রতিস্থাপন এখনো অনেক চ্যালেঞ্জিং।
স্টেম সেল থেরাপির গবেষণাগুলো ধীরে ধীরে উন্নত হচ্ছে এবং পারকিনসনসহ, মৃগী, ডায়াবেটিসের মতো রোগের দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা কমিয়ে আনছে। তবে, কিছু সীমাবদ্ধতা রয়ে গেছে, যেমন—রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার প্রতিক্রিয়া এবং কোষের দীর্ঘমেয়াদি কার্যকারিতা।
তবুও, গবেষকরা আশাবাদী যে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে এই থেরাপিগুলো আরও উন্নত হবে এবং সাধারণ চিকিৎসায় যুক্ত হবে।
সুমাইয়া বিনতে সেলিম / নিজস্ব প্রতিবেদক
তথ্যসূত্র: নেচার, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউশন অফ হেল্থ (এন,আই,এইচ)