চিনি হলো এক ধরনের কার্বোহাইড্রেট যা আমাদের প্রতিদিনের খাবারে ব্যবহার করা হয়। এসব কার্বোহাইড্রেট গ্রহণের পর পরিপাক হয়ে গ্লুকোজ, ফ্রুক্টোজ বা গ্যালাকটোজের মতো সাধারণ শর্করাতে পরিণত হয় যা শক্তির উৎস হিসাবে ব্যবহৃত হয়। তবে অতিরিক্ত শর্করা গ্রহণের ফলে স্থূলতা, ফ্যাটি লিভার, টাইপ-২ ডায়াবেটিস, দাঁতের সমস্যা, ত্বকের বলিরেখা, হৃদরোগ, বিষণ্নতা, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়া, ঘুমের সমস্যা, ক্যান্সার সহ আরো নানা রোগ দেখা দিতে পারে, যা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতির কারণ।
তবে সব ধরনের চিনি স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর নয়। কারণ প্রাকৃতিক চিনি এবং পরিশোধিত চিনি এর মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। প্রাকৃতিক চিনি বা ন্যাচারাল সুগার যেমন গ্লুকোজ (ভাত,রুটি), ফ্রুক্টোজ (ফল, কয়েক ধরনের সবজি), ল্যাকটোজ (দুধ), যা প্রাকৃতিক ভাবে পাওয়া যায়। এই ন্যাচারাল সুগার গ্রহণের ফলে কেবল শক্তি নয় খাবারের মিষ্টতার সাথে গুরুত্বপূর্ণ উপকারী খাদ্য উপাদান পাওয়া যায়। উদাহরণস্বরূপ, একটি মাঝারি আকারের আমের মধ্যে অন্যান্য ফলের তুলনায় ২০ গ্রাম থেকে বেশি শর্করা পাওয়া যায়।
টিউফ্টস বিশ্ববিদ্যালয়ের হিউম্যান নিউট্রিশন রিসার্চ সেন্টারের ডায়েট ও দীর্ঘস্থায়ী রোগ প্রতিরোধমূলক গবেষণার প্রধান এলিস লিচটেনস্টেইন বলেন,
“সাথে অন্যান্য খাদ্য উপাদান (প্রোটিন, ক্যালসিয়াম, আয়রন, ম্যাগনেসিয়াম, পটাশিয়াম, ভিটামিন সি, খাদ্য আঁশ বা রাফেজ) পাওয়া যায়।”
অতিরিক্ত চিনি বলতে পরিশোধিত চিনি যা রিফাইনিং সুগার, যা কর্ণ সিরাপ নামে পরিচিত এবং যা খাদ্য সংরক্ষণে, খাবারের স্বাদ বাড়াতে, কোমল পানীয় এবং আইসক্রিমের মতো খাবারে বাল্ক যোগ করতে ব্যবহার করা হয়। খাবারের সাথে অতিরিক্ত সুগার যোগ করা কোন ভিটামিন, খনিজ উপাদান কিংবা খাদ্যতালিকাগত আঁশ সরবরাহ করে না। তাই অতিরিক্ত শর্করা যোগ করাকে “জিরো ক্যালরি” হিসেবে অভিহিত করা হয়, কারণ এই ক্যালরিতে পুষ্টির ঘাটতি রয়েছে।
অতিরিক্ত কার্বোহাইড্রেট গ্রহণের ফলে অটোইমিউন ডিজঅর্ডার (ক্রনস্ ডিজিজ এবং মাল্টিপল স্ক্লেরোসিস), উচ্চ রক্তচাপসহ বিভিন্ন ধরনের ক্যান্সারের ঝুঁকি বেড়ে যায়। ২০২৩ বিএমসি মেডিসিন স্টাডির তথ্য অনুযায়ী, ৫ শতাংশ অতিরিক্ত চিনির পরিমাণ বৃদ্ধির ফলে ৬ শতাংশ হৃদরোগের এবং ১০ শতাংশ স্ট্রোকের উচ্চ ঝুঁকি রয়েছে।
“একটি ২০ আউন্সের কোকাকোলার বোতলে ৬৫ গ্রাম অতিরিক্ত সুগার রয়েছে, যা বেশিরভাগ মানুষের দৈনন্দিন শর্করা গ্রহণ সীমার ৩০ শতাংশ। তাই সোডা অথবা অন্যান্য মিষ্টি জাতীয় কোমল পানীয় পান ত্যাগ করা ,কম চিনি গ্রহণে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ, ”
বলেছেন উইলেট।
তাছাড়া ওজন বৃদ্ধি (স্থূলতা), ডায়াবেটিস, ফ্যাটি লিভার, দীর্ঘস্থায়ী প্রদাহ, বিষণ্নতা বা ডিপ্রেশন সহ আরো নানা ধরনের রোগ দেখা দিতে পারে।
অতিরিক্ত চিনি খাওয়া ত্যাগ করা কিংবা সীমিত পরিমাণে খাওয়া কেবল স্বাস্থ্য ঝুঁকি কমায় না, সাথে জীবনের মানও উন্নত করে। কারণ কম শর্করা গ্রহণে ক্ষতিকর অণু (এজিই-AGE) এর বৃদ্ধি ব্যাহত হয়,যা আলজেইমার রোগের সাথে জড়িত।
রক্তে বিদ্যমান অতিরিক্ত শর্করা, ত্বকের (কোলাজেন এবং প্রোটিন) লিপিড অথবা প্রোটিনের সাথে যুক্ত হয়ে ত্বকের বলিরেখা সৃষ্টি এবং এর স্থিতিস্থাপকতা নষ্ট করে। তাই কম শর্করা গ্রহণে ত্বকের স্বাস্থ্যও ভালো থাকে।
গুডসন বলেন,
“কম চিনি গ্রহণ, রক্তে শর্করার মাত্রা স্থিতিশীল রাখার মাধ্যমে শারীরিক সহনশীলতার মাত্রা বাড়ায় ও দীর্ঘমেয়াদি শক্তিশালী ও স্বাস্থ্যকর অভ্যাস গড়ে তুলতে সহায়তা করে।”
মস্তিষ্কে আবেগ নিয়ন্ত্রণের রাসায়নিক উপাদানগুলোর (যা মন-মেজাজকে প্রভাবিত করে) সুষ্ঠু ক্রিয়া করতে চিনি বাধা প্রদান করে। তাই সীমিত চিনি গ্রহণে বিষণ্নতার ঝুঁকি কমায় এবং চাপ গ্রহণের ক্ষমতা বাড়ায়। স্থায়ীভাবে চিনি গ্রহণ ত্যাগ করা কিংবা কম গ্রহণ করা বেশি উপকারী হলেও অস্থায়ীভাবে কমানোও স্বাস্থ্যের জন্য ভালো।
জেরাট্স্কি বলেছেন,
“লিভার স্টিওসিস আক্রান্ত কিশোর বালকের উপর, ৮ সপ্তাহের একটি ছোট পরীক্ষায় দেখা গেছে, তাদের খাদ্য তালিকায় কম চিনি সম্পন্ন খাবার রাখায়, তাদের লিভারের স্বাস্থ্যের উন্নতি হয়েছে।”
মেসারের মতে, রান্নায় কিংবা খাবারে চিনির পরিবর্তে অন্যান্য উপকরণ যেমন দারুচিনি, এলাচ, কাজু ইত্যাদি ব্যবহার করা যেতে পারে।
সর্বোপরি খাদ্যে কম চিনি গ্রহণে, স্বাস্থ্যের উন্নতি সহ ডায়াবেটিস এবং হৃদরোগের মতো অন্যান্য রোগের ঝুঁকি কমানো সম্ভব। ন্যাচারাল সুগার সমৃদ্ধ খাদ্য গ্রহণে পুষ্টির চাহিদা পূরণ হওয়ার সাথে স্বাস্থ্যও ভালো থাকবে। ফলস্বরূপ একটি দীর্ঘস্থায়ী এবং স্বাস্থ্যকর জীবন যাপন করা সম্ভব হবে।
স্বর্ণালী সরকার / নিজস্ব প্রতিবেদক
তথ্যসূত্র : ন্যাশনাল জিওগ্রাফী, ইটিংওয়েল.কম