ঊনবিংশ শতাব্দীর এক অনবদ্য আবিষ্কার হলো কম্পিউটার বা গণনাকারী যন্ত্র। মানুষের দৈনন্দিন জীবনধারা থেকে শুরু করে শিক্ষা, গবেষণা, চিকিৎসা ক্ষেত্রেই এই কম্পিউটার এর ব্যবহার এনে দিয়েছে নতুন মাত্রা। উন্নয়নকে করছে ত্বরান্বিত। সময়ের সাথে প্রতিটি প্রযুক্তির মতো কম্পিউটার বা গণনাকারী যন্ত্র পেয়েছে নতুনত্ব। এরই ধারাবাহিকতায় একটি ঘরের সমান জায়গা থেকে কম্পিউটার এসেছে আমাদের হাতের মুঠোয়, পাশাপাশি হয়েছে শক্তিশালীও। বর্তমান সময়ের সবচেয়ে আলোচিত এবং সবচেয়ে কৌতুহল জাগানো এক কম্পিউটারের নাম হলো কোয়ান্টাম কম্পিউটার ।
কম্পিউটার নিয়ে এখনো প্রতিনিয়ত কাজ চলছে। গুগলের মতো বড় বড় জায়ান্ট কোম্পানিগুলো কোটি কোটি টাকা ঢালছে কোয়ান্টাম কম্পিউটার কে নিজেদের আয়ত্তে আনতে এবং তা ব্যবহার করতে। সেই কম্পিউটারকে আরো নিখুঁত এবং কার্যকর করে গড়ে তুলতে MIT এর একদল গবেষক নতুন ধরনের একটি কিউবিট সার্কিট তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন।
কোয়ান্টাম কম্পিউটার নিয়ে সর্বপ্রথম কাজ করা হয় ১৯৯৮ সালে। যা ছিল একদম প্রথম ধাপ। কোয়ান্টাম কম্পিউটার নানাভাবে সাধারণ কম্পিউটার থেকে অনেকটা আলাদা। প্রথমত সাধারণ কম্পিউটারগুলো তৈরি হয় বিট এর ধারণার উপর ভিত্তি করে। কম্পিউটার এর ভাষায় 0 এবং 1 কে বিট বলা হয়। কোয়ান্টাম কম্পিউটার ব্যবহার করে কোয়ান্টাম বিট যাকে সংক্ষেপে কিউবিট বলা হয়। 1s এবং 0s কে কোয়ান্টাম বিট হিসেবে সম্বোধন করা হয়।
সাধারণভাবে ক্লাসিক্যাল কম্পিউটারের ব্যবহৃত বিট এবং কোয়ান্টাম কম্পিউটারে ব্যবহৃত কিউবিট একই মনে হতে পারে কিন্তু এখানে একটি তফাৎ রয়েছে। ক্লাসিক্যাল কম্পিউটার যেকোনো তথ্য কে 0 এবং 1 এ কনভার্ট করে। কেননা ক্লাসিক্যাল কম্পিউটার কাজ করে ট্রানজিস্টরের মাধ্যমে। ট্রানজিস্টর অন মানে 1 আর ট্রানজিস্টর অফ মানে 0 ।
সাধারণ বিটের সাথে কোয়ান্টাম বোর্ডের পার্থক্য এখানেই। ক্লাসিক্যাল কম্পিউটারের বিট যেখানে যেকোনো নির্দিষ্ট সময়ে 0 অথবা 1 যেকোনো একটি হতে পারে সেখানে কোয়ান্টাম কম্পিউটারের কিউবিট একই সময়ে 0 এবং 1 একই সাথে হতে পারে। যাকে বলা হয় সুপার পজিশন । অনেকটা শ্রোডিঞ্জারের বিড়ালের মতো। যেখানে বিড়ালটি একই সাথে মৃত অথবা জীবিত থাকতে পারে।
কোয়ান্টাম ফিজিক্সের সুপার পজিশনের ধারণা থেকেই কোয়ান্টাম কম্পিউটারের উৎপত্তি। সুপার পজিশনের ধারণাটি ব্যবহার করার ফলে কোয়ান্টাম কম্পিউটার সাধারণ ক্লাসিক্যাল কম্পিউটারের চেয়ে অনেক বেশি দ্রুত এবং নিখুঁত হয়। যেহেতু একই সাথে একাধিক বিট নিয়ে কোয়ান্টাম কম্পিউটার কাজ বা গণনা করতে সক্ষম তাই স্বাভাবিকভাবেই কোয়ান্টাম কম্পিউটার অনেক তাড়াতাড়ি ফলাফল দিতে সক্ষম।
উদাহরণস্বরূপ বলা যায়- একটি গোলক ধাঁধা সমাধানের ক্ষেত্রে ক্লাসিক্যাল কম্পিউটার যেখানে একটি একটি পথ যাচাই করে তারপর সঠিক পথটি বাছাই করবে কোয়ান্টাম কম্পিউটার সেখানে একসাথে সবগুলো পথ একই সময় যাচাই করার মাধ্যমে সঠিক পথটি নির্ণয় করতে সক্ষম। বোঝাই যাচ্ছে কোয়ান্টাম কম্পিউটার যেমন দ্রুত কাজ করতে পারে তেমনি কোনো Error বা ভুল হলে এ ভুলকে সংশোধন করার মতো ব্যবস্থাও কোয়ান্টাম কম্পিউটারে থাকা অত্যন্ত জরুরী।
এর আগে ট্রান্সমন কিউবিট ব্যবহার করা হতো। ট্রান্সমন কিউবিট হলো এক ধরনের সুপারকন্ডাক্টিং কিউবিট। এগুলো মূলত জোসেফসন জংশনের (জোসেফসন জাংশন মূলত একটি ডিভাইস যা দুটি সুপার কন্ডাক্টর এর সাথে আরো দুটি দুর্বল সুপার কন্ডাক্টর বা নন সুপার কন্ডাক্টর এর সাথে যুক্ত করে) কাজ করে। আরো এক ধরনের কিউবিট বর্তমান সময় ব্যবহার করা হয় যা হলো ফ্লাক্সোনিয়াম কিউবিট।
এটি এক বা একাধিক জোসেফসন জংশন দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত একটি সুপারকন্ডাক্টিং লুপ দ্বারা কাজ করে। একটি ফ্লাক্সোনিয়াম কিউবিটের মূল বৈশিষ্ট্য হলো যে এটি লুপের থ্রেডিং কোয়ান্টাইজড ম্যাগনেটিক ফ্লাক্সের উপর নির্ভর করে, যা কিউবিট অবস্থাগুলোকে ম্যানিপুলেট করার জন্য নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
সাধারণ অবস্থায়, চুম্বকীয় ফ্লাক্স যেকোনো মান নিতে পারে, কিন্তু যখন কোনো সুপারকন্ডাক্টিং লুপে চুম্বকীয় ফ্লাক্স প্রবাহিত হয়, তখন তা নির্দিষ্ট মাত্রায় বিভক্ত হয়ে যায়। অর্থাৎ, ফ্লাক্সের মান অসংখ্য ছোট ছোট ধাপ বা কোয়ান্টা আকারে আসে। এই অবস্থাকে কোয়ান্টাইজড ম্যাগনেটিক ফ্লাক্স বলে। অন্যদিকে চুম্বকীয় ফ্লাক্স হলো একটি পদার্থবিজ্ঞানের পরিমাপ, যা কোনো নির্দিষ্ট এলাকার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত চুম্বকীয় ক্ষেত্রের শক্তি বা প্রবাহকে প্রকাশ করে।
তবে এমআইটির গবেষক দল একসাথে দুটো ফ্লাক্সোনিয়াম কিউবিট ব্যবহারের প্রস্তাব দিয়েছে। এই ডিজাইনটিকে বলা হচ্ছে ফ্লাক্সোনিয়াম-ট্রান্সমন-ফ্লাক্সোনিয়াম আর্কিটেকচার বা FTF যা শুধুমাত্র ফ্লাক্সোনিয়াম কিউবেটের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী এবং নিখুঁত।
কোয়ান্টাম সিস্টেমস গ্রুপের পদার্থবিজ্ঞানের একজন স্নাতক শিক্ষার্থী লিওন ডিং যিনি বর্তমানে পিএইচডি করছেন FTF আর্কিটেকচারের গবেষণাপত্রের প্রধান লেখক বলেছেন,
“এই শক্তিশালী কিউবেট ও গেইট তৈরির মাধ্যমে বৃহৎ পরিসরে কোয়ান্টাম কম্পিউটার তৈরীর যাত্রা শুরু হলো। আমাদের এই দ্বি-কিউবিট সিস্টেম অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য। আমাদের পরবর্তী পদক্ষেপ হলো এ কিউবেট এর সংখ্যা আরো বাড়ানো।”
তাদের এই ডিজাইন এক কিউবিট গেট ব্যবহারের সময় ৯৯.৯৯ শতাংশ নির্ভুল হয় এবং দুই কিউবিট গেট ব্যবহারের সময় ৯৯.৯% নির্ভুল হয়। কোন প্রকার সন্দেহ ছাড়াই তাদের এই কাজ প্রশংসার দাবিদার। সামনের দিনগুলোতে কোয়ান্টাম কম্পিউটার আরও নির্ভুল এবং শক্তিশালী রূপে এর মতো হবে এই আশা করাই যায়। এ প্রযুক্তির হাত ধরে মানবজীবন হবে আরো উন্নত এবং গতিশীল। মানুষের কাজ হবে আরো নিখুঁত।
জুম্মান আল সিয়াম / নিজস্ব প্রতিবেদক
তথ্যসূত্র: ইন্টারেস্টিং ইঞ্জিনিয়ারিং, নিউজ.এমআইটি.এডু