আমরা যে মহাবিশ্বে বাস করি, তার প্রায় ৮০% ভরই গঠিত এমন এক রহস্যময় উপাদান দিয়ে, যাকে বলা হয় ডার্ক ম্যাটার। কিন্তু এর প্রকৃতি ও গুণাগুণ সম্পর্কে আজও বিজ্ঞানীরা সুনির্দিষ্ট ধারণা পাননি। পৃথিবী থেকে শুরু করে সমগ্র মহাবিশ্বে যত গবেষণা হয়েছে, সেখানেও ডার্ক ম্যাটারের অস্তিত্ব কেবলমাত্র পরোক্ষভাবে অনুমান করা যায়। ফলে একে বোঝার জন্য বিজ্ঞানীরা ক্রমাগত নতুন প্রযুক্তি ও পরীক্ষার পদ্ধতি খুঁজে চলেছেন। এই প্রেক্ষাপটে উঠে এসেছে থোরিয়াম-229 নামক একটি বিশেষ পরমাণুর সম্ভাবনা।
১৯৭৬ সালেই বিজ্ঞানীরা লক্ষ্য করেন, থোরিয়াম-229-এর নিউক্লিয়ার রেজোন্যান্স ফ্রিকোয়েন্সি অস্বাভাবিকভাবে কম। এর ফলে প্রচলিত লেজার প্রযুক্তি দিয়েই এটিকে উত্তেজিত করা সম্ভব। তবে প্রায় পাঁচ দশক ধরে এই রেজোন্যান্সকে যথাযথভাবে মাপা সম্ভব হয় নি। অবশেষে সম্প্রতি জার্মানির PTB (National Metrology Institute) এবং যুক্তরাষ্ট্রের University of Colorado-এর গবেষকরা সফলভাবে এটি নির্ভুলভাবে মাপতে সক্ষম হয়েছেন। এটাই ভবিষ্যতের নিউক্লিয়ার ঘড়ির পথ সুগম করছে।
একটি থোরিয়াম-229 ভিত্তিক নিউক্লিয়ার ঘড়ি এমন সূক্ষ্ম পরিবর্তন ধরতে পারবে, যা মাধ্যাকর্ষণের চেয়েও ১০০ মিলিয়ন গুণ দুর্বল বল দ্বারা সংঘটিত হয়। আরও বিস্ময়ের বিষয় হলো, এটি বর্তমান ডার্ক ম্যাটার শনাক্তকরণ পদ্ধতির তুলনায় প্রায় এক লক্ষ গুণ বেশি রেজোলিউশন দিতে সক্ষম হবে। অর্থাৎ, এতদিন যেসব ক্ষুদ্রতম ভৌত পরিবর্তন ধরাই যেত না, সেগুলোকেও এই ঘড়ি সহজেই নির্ণয় করতে পারবে।
গবেষকরা মনে করছেন, যদি ডার্ক ম্যাটার মহাকাশ জুড়ে তরঙ্গ আকারে বিদ্যমান থাকে, তবে এটি থোরিয়াম-229 নিউক্লিয়ার ঘড়ির টিক-টকের মধ্যে ক্ষুদ্র বিচ্যুতি তৈরি করবে। সময়ের এই সামান্যতম অস্বাভাবিকতাই ডার্ক ম্যাটারের উপস্থিতি ও ভরের প্রকৃতি নির্ধারণে সহায়তা করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। যদিও এখনও পর্যন্ত এ ধরনের কোনো সংকেত পাওয়া যায়নি, তবুও গবেষকরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন যে এটি ভবিষ্যতের ডার্ক ম্যাটার অনুসন্ধানে এক বিপ্লবী হাতিয়ার হয়ে উঠবে।
নিউক্লিয়ার ঘড়ির সম্ভাবনা শুধুমাত্র বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানেই সীমাবদ্ধ নয়। একবার এই প্রযুক্তি পূর্ণতা পেলে, এটি আমাদের নেভিগেশন সিস্টেম, যোগাযোগ ব্যবস্থা, বিদ্যুৎ গ্রিড নিয়ন্ত্রণ এবং বৈজ্ঞানিক পরিমাপে এক অভূতপূর্ব অগ্রগতি এনে দেবে। অন্যভাবে বললে, এটি মানবসভ্যতার সময় নির্ণয়ের ধারণাকেই নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করতে পারে।