প্রকৃতি আমাদের জন্য এক বিস্ময়কর শিক্ষাগুরু। যেখানে মানুষের তৈরি জটিল সমস্যাগুলোর সহজ ও টেকসই সমাধান খুঁজে পেতে আমরা প্রকৃতি থেকে প্রতিনিয়ত নতুন পথ আবিষ্কার করে চলেছি। এমনই এক চমৎকার উদাহরণ হলো ফাঙ্গাসের মাধ্যমে কার্বন ফাইবার পুনর্ব্যবহার করার নতুন পদ্ধতি, যা পরিবেশ সংরক্ষণ ও মূল্যবান সম্পদের পুনরুদ্ধারে নতুন সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে।
কার্বন ফাইবার কী এবং কেন এটির পুনর্ব্যবহার চ্যালেঞ্জিং?
কার্বন ফাইবার একটি অত্যন্ত মজবুত ও হালকা উপাদান, যা বিমানের কাঠামো ও উইন্ড টারবাইনের ব্লেড তৈরিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে এর কার্যক্ষমতা হ্রাস পাওয়ায় এটি নিরাপত্তার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে। একই সাথে, এটি পুনর্ব্যবহারের ক্ষেত্রে একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ, এই কার্বন ফাইবার পলিমার ম্যাট্রিক্সের সাথে মিশ্রিত থাকে।
পলিমার ম্যাট্রিক্স হলো এমন এক ধরনের পদার্থ যা কার্বন ফাইবারকে অত্যন্ত হালকা, মজবুত ও শক্তিশালী উপাদানে পরিণত করার পাশাপাশি এর পুনর্ব্যবহারের প্রক্রিয়াকে অত্যন্ত জটিল করে তোলে। ফলে মেয়াদোত্তীর্ণ কার্বন ফাইবার সাধারণত ডাম্পিং গ্রাউন্ডে ফেলে রাখা হয় অথবা ইনসিনারেটর (দহন চুল্লি) ব্যবহার করে পোড়ানো হয়। ইনসিনারেটর হলো একটি বিশেষ যন্ত্র যা বর্জ্য পুড়িয়ে ধ্বংস করতে ব্যবহৃত হয়। তবে এতে বিপজ্জনক গ্যাস নির্গত হওয়ার কারণে এটি জলবায়ু পরিবর্তনকে ত্বরান্বিত করে।
২০৩০ সালের মধ্যে কার্বন ফাইবার দিয়ে নির্মিত শত শত বাণিজ্যিক বিমান ব্যবহারের অনুপযুক্ত হয়ে পড়বে এবং ২০৫৫ সালের মধ্যে উইন্ড টারবাইন থেকে লক্ষ লক্ষ টন বর্জ্য সৃষ্টি হবে। এর প্রধান কারণ হলো, এই উপাদানগুলোর কার্যকারিতার মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়া এবং পুনর্ব্যবহারের প্রক্রিয়া অত্যন্ত কঠিন হওয়া। তবে বর্তমানে এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় বিজ্ঞানীরা এমন একটি সমাধান খুঁজেছেন, যা কার্বন ফাইবারকে পুনর্ব্যবহারযোগ্য করার পাশাপাশি পরিবেশ সংরক্ষণেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
ফাঙ্গাস কী এবং কীভাবে কার্বন ফাইবার পুনর্ব্যবহারে এটি সহায়তা করে?
ফাঙ্গাস হলো এক ধরনের জীব যা উদ্ভিদ ও প্রাণীর থেকে ভিন্ন। এটি মূলত ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাসের মতো অণুজীবের অন্তর্ভুক্ত, তবে ব্যাকটেরিয়ার মতো এককোষী এবং উদ্ভিদের মতো বহুকোষী ফাঙ্গাসও রয়েছে।
ফাঙ্গাসের কিছু গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য:
১. ক্লোরোফিল নেই – এটি উদ্ভিদের মতো সালোকসংশ্লেষণ করতে পারে না।
২. পচন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে খাদ্য গ্রহণ করে – মৃত অথবা জীবিত বস্তু থেকে পুষ্টি সংগ্রহ করে।
৩. প্রজনন করে স্পোরের মাধ্যমে – বাতাস, পানি বা অন্যান্য মাধ্যমের সাহায্যে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।
৪. পরিবেশের জন্য উপকারী ও ক্ষতিকর হতে পারে – কিছু ফাঙ্গাস ওষুধ (যেমন: পেনিসিলিন) তৈরি করতে সাহায্য করে, আবার কিছু ফাঙ্গাস রোগ সৃষ্টি করতে পারে।
তবে এই গবেষণায় ব্যবহৃত ফাঙ্গাস: Aspergillus nidulans
এই গবেষণায় Aspergillus nidulans নামক এক ধরনের ছত্রাক (ফাঙ্গাস) ব্যবহার করা হয়েছে। এটি পরিবেশে সহজেই পাওয়া যায় এবং বিভিন্ন শিল্প ও গবেষণায় ব্যবহৃত হয়।
কেন এটি গুরুত্বপূর্ণ?
১. এটি বিভিন্ন রাসায়নিক যৌগ তৈরি করতে পারে
২. এটি পলিমার ম্যাট্রিক্সকে ভেঙে মূল্যবান রাসায়নিক উৎপন্ন করতে সক্ষম।
৩. এটি দ্রুত বংশবৃদ্ধি করে এবং সহজে নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে চাষ করা যায়।
এই ফাঙ্গাসের সাহায্যে কানসাস বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববিজ্ঞানের অধ্যাপক বার্ল ওকলে (Burl Oakley) এবং তার গবেষণা দল কার্বন ফাইবারের পলিমার ম্যাট্রিক্স থেকে পরিবেশবান্ধব উপায়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ রাসায়নিক পদার্থ তৈরিতে সক্ষম হয়েছেন, যা মূলত দুই ধাপে সম্পন্ন হয়—
১. প্রথম ধাপে, উচ্চ চাপ ও তাপ প্রয়োগ করে কার্বন ফাইবারের পলিমার ম্যাট্রিক্স আলাদা করা হয়। এতে কার্বন ফাইবারের ৯৭% মূল শক্তি বজায় থাকে এবং তা পুনরায় ব্যবহারযোগ্য হয়।
২. দ্বিতীয় ধাপে, গবেষকরা Aspergillus nidulans নামক ফাঙ্গাস ব্যবহার করে পলিমার ম্যাট্রিক্সকে একটি রাসায়নিক পদার্থে রূপান্তর করেন।
এই ফাঙ্গাস পলিস্টাইরিন ম্যাট্রিক্স থেকে বেনজোয়িক অ্যাসিড নামক একটি রাসায়নিক পদার্থ তৈরি করে এবং গবেষকরা এই প্রক্রিয়াকে ব্যবহার করে অক্টাট্রিয়েনোইক অ্যাসিড নামক একটি মূল্যবান যৌগ তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন। যা অ্যান্টিবায়োটিক, প্রদাহবিরোধী ওষুধসহ বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থ তৈরির জন্য ব্যবহারযোগ্য হয়ে উঠছে।
এছাড়াও, এই পদ্ধতিটি কার্বন ফাইবার পুনর্ব্যবহারের পাশাপাশি এর ম্যাট্রিক্স উপাদান থেকেও মূল্যবান রাসায়নিক উপকরণ উৎপাদনের সুযোগ তৈরি করে। আরও চমকপ্রদ ব্যাপার হলো, এই পুরো প্রক্রিয়াটি মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যে সম্পন্ন হয় এবং শিল্প পর্যায়ে বিশেষভাবে প্রয়োগযোগ্য। গবেষকরা এখন এই পদ্ধতিকে আরও উন্নত করতে কাজ করছেন, যাতে উৎপাদনের পরিমাণ ও খরচের দিক থেকে এটি আরও কার্যকর হয়
অধ্যাপক ওকলে বলেন,
“আমরা ইতোমধ্যে আরও উন্নত ফাঙ্গাস তৈরি করেছি এবং আশা করছি উৎপাদনের হার আরও বাড়ানো সম্ভব।”
পরিশেষে বলা যায়, এ ধরনের গবেষণা আমাদের শেখায় যে, প্রকৃতির সাথে একাত্ম হয়ে আমরা আমাদের সমস্যাগুলোর টেকসই সমাধান খুঁজে পেতে পারি। কার্বন ফাইবার পুনর্ব্যবহারের মাধ্যমে পরিবেশ সংরক্ষণ ও মূল্যবান রাসায়নিক উৎপাদন সম্ভব, যা বিজ্ঞানের এক বিশাল সাফল্য। তরুণ প্রজন্মের জন্য এটি শিক্ষণীয়, কারণ এটি নতুন কিছু শেখার কৌতূহল বাড়ানোর পাশাপাশি প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসা জাগিয়ে তুলবে, যা ভবিষ্যতে আরও টেকসই ও পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি উদ্ভাবনে সহায়ক হবে।
ফাতেমা আক্তার মুন্নি / নিজস্ব প্রতিবেদক
তথ্যসূত্রঃ অ্যাডভান্স সাইন্স নিউজ, টেকনোলজি নেটওয়ার্ক