বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল-এর রহস্যের উত্তর পাওয়া যায়নি, মানে এই না যে দুর্ঘটনাগুলোকে বিজ্ঞানের আলোকে আলোচনা করা যাবে না। বিজ্ঞানভিত্তিক ব্যাখ্যা নেই এমন অনেক ঘটনা রয়েছে, যা পৃথিবীতে অনেক বেশি আলোচিত। এমন কিছু জিনিস আছে যার সমাধান আজ পর্যন্ত পাওয়া যায় নি।
বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল (ডেভিলস ট্রায়াঙ্গেল বা শয়তানের ত্রিভুজ) এর মধ্যে অন্যতম আলোচিত একটি বিষয়। রহস্য আর আশ্চর্যের নানা কাহিনী প্রচলিত আছে একে ঘিরে। এটি আটলান্টিক মহাসাগরের একটি ত্রিভুজাকৃতির বিশেষ স্থান, যেখান থেকে বেশ কিছু জাহাজ ও উড়োজাহাজ হারিয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। আর অদ্ভুত ভাবে তাদের আর খুঁজে পাওয়া যায় নি, এমনকি কোনো ধ্বংসাবশেষ বা চিহ্ন পর্যন্ত কেউ খুঁজে পায় নি।
এই রহস্যের খোঁজে কয়েকজন রিসার্চার কাজ শুরু করে দেন এবং এমন কিছু প্রমাণ পেয়ে যান, যা ব্যাখ্যা করে বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল কেবল রহস্যময় স্থান নয় বরং বেশিরভাগ সময় লেখকরা ও কন্সপিরেসি থিওরিস্টরা বাড়িয়ে অতিরঞ্জিত করে বর্ণনা করেছেন। যার ফলে সাধারণ মানুষরা এই স্থানটিকে অতিপ্রাকৃত বলে ধরে নিয়েছে। প্রথম পর্বে আমরা বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলের কিছু রহস্যের কথা জেনেছি, এ পর্বে জানব সেই রহস্যগুলোর সম্ভাব্য ব্যাখ্যা সম্পর্কে!
প্রথম পর্ব পড়ুন এখানেঃ বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল: অতিপ্রাকৃত ঘটনা নাকি অন্যকিছু; পর্ব-১
এখন দেখা যাক কিছু সমাধান যা বিজ্ঞানীরা ব্যাখ্যা করেছেন।
আমেরিকার বিজ্ঞানীরা দাবী করেছেন, বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলের দুর্ঘটনার জন্য দায়ী ২৭৩ কি.মি. বেগে ধাবমান বিধ্বংসী ঝড়। এই ঝড় সৃষ্টি হয় হেক্সাগোনাল ক্লাউড বা ষড়ভুজাকৃতি মেঘ কুন্ডলী থেকে। বলা হচ্ছে, বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল উপর এই হেক্সাগনাল ক্লাউড এমনভাবে জমাট বাঁধে যা থেকে এয়ার বম্ব বা বায়ুবোমা তৈরি হয়। এই বিধ্বংসী ঝড়ের এত ক্ষমতা, যে এটি কোনো সমুদ্রপৃষ্ঠের পানিকে আঘাত করলে ৪০ থেকে ৫০ ফুট উচু স্রোত বা ঢেউ তৈরি করতে পারে যা সমুদ্রের জাহাজকে নিমিষেই ধ্বংস করে দিতে পারে। আবার আকাশের কোন উড়োজাহাজকে আঘাত হানলে সহজেই তা ধ্বংস হয়ে যেতে পারে এবং গভীর সমুদ্রে হারিয়ে যায়।
এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, এতবছর ধরে শত শত জাহাজ উড়োজাহাজ ধ্বংস হয়েছে আর এদের ধ্বংসাবশেষ খুঁজে পাওয়া যায়নি কেন?
এর উত্তর হিসেবে দুটি প্রসঙ্গ আলোচনা করা হয়েছে ।
যার প্রথমটি হচ্ছে গলফস্ট্রিম। আমরা জানি সমুদ্রে দুই ধরনের স্রোত রয়েছে, একটি হলো উষ্ণ স্রোত, অপরটি হলো শীতল স্রোত। গলফস্ট্রিম হলো একটি উষ্ণ সমুদ্র স্রোত যা মেক্সিকো উপসাগর থেকে আটলান্টিক মহাসাগরের দিকে প্রবাহিত হয়। এই স্রোতের বেগ খুব বেশি, তাই একে বলা হয় মহাসমুদ্রের মাঝে এক নদী। বহমান নদীর মতন গলফস্ট্রিমও ভাসমান স্রোতের সাথে সবকিছু প্রবাহিত করে নিয়ে যেতে পারে আর সেই কারণে হয়তো জাহাজ বা উড়োজাহাজের ধ্বংসাবশেষ পানিতে প্রবাহিত হয়ে অন্যত্র চলে যায় এবং কোনদিন খুঁজে পাওয়া যায়নি।
এখন আসি দ্বিতীয় প্রসঙ্গে, যা হচ্ছে পুয়ের্তোরিকোর খাদ বা পুয়ের্তোরিকোর ট্রেঞ্চ। আটলান্টিক মহাসাগরের সবচাইতে গভীরতম খাদ এটি, যা বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলের মধ্যেই পড়ে। এটি সমুদ্রের তলদেশে এক সুবিশাল গর্ত, যার গভীরতা প্রায় ২৮,৩৭৩ ফুট। এই গভীরতা থেকে এটা ধারণা করা যায় যে, এই গভীরতায় কোন জাহাজ বা উড়োজাহাজের ধ্বংসাবশেষ গিয়ে এই খাদের মধ্যে জমা হয় তাহলে স্বাভাবিকভাবেই তার খোঁজ পাওয়া সম্ভব নয়।
আরেকটি প্রশ্ন থেকে যায়, কেন এ অঞ্চলে কম্পাস ঠিকভাবে কাজ করে না?
লেখক ডেন কুইজার মনে করেন, এই অঞ্চলে ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক বল কাজ করে বলে নাবিকরা পথ হারায়। আরেকটা কারণ এখানে বলা যায় যে, এই অঞ্চলে সমুদ্র তলদেশে প্রচুর পরিমাণ মিথেন গ্যাস আছে, যা জাহাজ ডোবার কারণ বলে দেখা গেছে। পরীক্ষাগারে দেখা গেছে গ্যাসের বুদবুদ পানির ঘনত্বকে কমিয়ে দেয়; হঠাৎ যখন মিথেন গ্যাস উদগীরণ শুরু হয় তখন পানির প্লবতা কমে যায়। এমন পরিস্থিতিতে পানিতে ভাসতে থাকা জাহাজ হঠাৎ করেই ডুবে যায়। ইউএস সরকারের মতে, বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল বলে কোনোকিছুর অস্তিত্বই নেই। এই অঞ্চলে অনেক কার্গো জাহাজ চলাচল করে এবং এখানে দুর্ঘটনার পরিমাণ অন্যান্য সমুদ্র অঞ্চল অপেক্ষা বেশি নয়।
এইসব ব্যাখ্যা থেকে বোঝা যায় বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলকে রহস্যময় বানানোর ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ভূমিকা লেখকদের। ফলে বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলকে ডেভিলস ট্রায়াঙ্গেলে পরিণত করে হাজারো কল্পনা ও রহস্যের সৃষ্টি হয় সবার মাঝে।
জাকিয়া খানম তিশা/ নিজস্ব প্রতিবেদক
তথ্যসূত্রঃ হাউ স্টাফ ওয়ার্কস, news.com.au