ফোস্কা হলো ত্বকের উপরে অবস্থিত তরল পদার্থপূর্ণ একটি পকেট। চিকিৎসকরা অনেকসময় ফোস্কাকে ভেসিকল ও বলে।
সাধারণত ত্বকের সাথে কোনো কিছুর যখন ঘর্ষণ হয়, তখন ত্বকের স্তরগুলো পরস্পর পৃথক হয়ে যায় ও সেখানে ফাঁকা জায়গার সৃষ্টি হয় এবং জায়গাটি তরল দিয়ে পূর্ণ হয়। পরবর্তীতে ত্বকের উপরে এই তরলপূর্ণ পকেট দেখা যায়। এটি হওয়ার কিছু উল্লেখযোগ্য কারণ রয়েছে। যেমনঃ ঘর্ষণ, হিমশীতল, জ্বলন, সংক্রমণ, পুড়ে যাওয়া এবং রাসায়নিক পদার্থ।
ফোস্কা সাধারণত এপির্ডামিস অর্থাৎ ত্বকের উপরে গঠিত হয় এবং এর উদ্দেশ্য হচ্ছে ত্বকের নিচের স্তরগুলোকে সুরক্ষা দেওয়া। এটি কোথায়, কিভাবে কি কারণে তৈরি হচ্ছে তার উপর নির্ভর করে এটি সিরাম, প্লাজমা, রক্ত বা পুঁজ দিয়ে পূর্ণ হয়।
ফোস্কার প্রকারভেদঃ
১. ঘর্ষণজনিত
২. রক্তেজমা
৩. তাপজনিত
ফোস্কা হওয়ার কারণসমূহঃ
১. ঘর্ষণঃ
ফোস্কা অনেকসময় অতিরিক্ত ঘর্ষণজনিত কারণে তৈরি হয়। অত্যাধিক বাদ্যযন্ত্র বাজানোর কারণেও এটি হতে পারে। ঘর্ষণের ফলে হাত বা পায়ের অঞ্চল বার বার ক্ষতিগ্রস্ত হয়, হাতের তালু এবং পায়ের তৃতীয় অংশে তাই অনেক সময়ই ফোস্কা হতে দেখা যায়। দীর্ঘসময় জুতা পরে থাকলে বা খুব আঁটসাঁট জুতা পরলেও এটি হয়। এটি সাধারণত ভেজা বা শুকনো পরিবেশের তুলনায় স্যাঁতসেঁতে অবস্থায় বেশি হয়।
২. অত্যাধিক তাপমাত্রাঃ
অত্যাধিক তাপমাত্রায় ত্বকের কোনো জায়গা পুড়ে গেলেও ফোস্কা হতে পারে। কোনো জায়গা পুড়ে গেলে ঘটনার কয়েকদিন পর প্রথম ডিগ্রি পোড়ার ফোস্কা দেখা যায়, তবে দ্বিতীয় ডিগ্রি পোড়ার ফোস্কাগুলো হওয়ার সাথে সাথে ফেটে যায়।
আবার, অনেকসময় অত্যন্ত শীতল তাপমাত্রা ও ফোস্কার কারণ হতে পারে। তবে উভয় ক্ষেত্রে এটি তৈরির উদ্দেশ্য হচ্ছে ত্বকের নিম্নস্তরকে সুরক্ষা দেওয়া।
৩. চাপা পড়া (ছেঁচে যাওয়া) এবং চিমটিঃ
অতিরিক্ত চাপে যখন ত্বকের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত কোনো রক্তনালি ফেটে যায়, তখন ত্বকের স্তরগুলোর মধ্যে ফাঁকা জায়গার সৃষ্টি হয় এবং ফাঁকা জায়গাটি দ্রুত রক্ত দিয়ে পূর্ণ হয়, তখন তাকে রক্তে ভরা ফোস্কা বলে।
৪. রাসায়নিক এক্সপোজারঃ
অনেকসময় রাসায়নিক পদার্থের প্রভাবে ত্বকে ফোস্কা হয়। এটি মূলত ‘ডার্মাটাইটিস‘ হিসেবে পরিচিত। উল্লেখযোগ্য কিছু রাসায়নিক পদার্থ রয়েছে, সেগুলোর কারণে ত্বকে এই ধরণের প্রদাহ হতে পারে। যেমনঃ প্রসাধনী, ডিটারজেন্ট, দ্রাবক, নিকেল সালফেট, বিষাক্ত পোকার কামড়, সরিষার গ্যাস প্রভৃতি।
মেডিকেল অবস্থা (রোগ):
বেশ কয়েকটি মেডিকেল অবস্থা রয়েছে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো⇨
- চিকেনপক্স: প্রথমে ছোট ছোট ফুসকুড়ি তৈরি হয় এবং পরবর্তীতে একত্রে ফুসকুঁড়ি গুলো ফোস্কার মত গঠন তৈরি করে।
- হারপিস: অত্যাধিক ঠান্ডায় হারপিস সিমপ্লেক্স ভাইরাসের আক্রমণে ‘হারপিস ফোস্কার‘ ক্লাস্টার তৈরি হয়।
- বুলস ইমপিটিগো: সাধারণত ২ বছরের কম বয়সী শিশুদের হাতে, পায়ে ফোস্কা তৈরি হয়।
- অ্যাকজিমা: ত্বকে প্রথমে ফোস্কা দেখা যায় এবং পরবর্তীতে ক্র্যাকিং, ক্রাস্টিং এবং ফ্লাকিং হয়।
- ডিশিড্রোসিস: কোনো দুর্ঘটনা ঘটার সাথে সাথে দ্রুত এই ধরনের ফোস্কার দেখা পাওয়া যায়।
- বুলাস পেমফিগয়েড: এটি একটি অটোইমিউন রোগ এবং ত্বককে প্রভাবিত করে ফোস্কা তৈরি করে। সাধারণত বয়স্ক রোগীদের এই রোগটি বেশি হয়ে থাকে।
- পেমফিগাস: এটি ত্বকের কোষঝিল্লিকে প্রভাবিত করে এবং ফোস্কা সৃষ্টি করে।
- কাটেনিয়াস রেডিয়েশন সিন্ড্রোম: বিকিরণের কারণে ত্বকে ফোস্কা গঠিত হয়।
- এপিডার্মোলাইসিস বুলোসা: এটি মূলত টিস্যুর জিনগত একটি রোগ, যার প্রভাবে ত্বকে ফোলাভাব এবং শ্লেষ্মা ঝিল্লি তৈরি হয়।
ফোস্কা কিভাবে গঠিত হয়?
ফোস্কা হওয়ার প্রায় ৬ ঘণ্টা পরে, ফোস্কাটির গোড়ার কোষগুলো অ্যামিনো এসিড ও নিউক্লিওসাইড গ্রহণ করতে শুরু করে এবং এগুলোই হচ্ছে মূলত প্রোটিন ও DNA এর বিল্ডিং ব্লক। ২৪ ঘণ্টা পরে ত্বকে দ্রুত কোষগুলো বৃদ্ধি পেতে শুরু করে এবং নতুন ত্বকের কোষগুলো অবিচ্ছিন্নভাবে গঠিত হয়।
৪৮ ঘণ্টা পরে, ত্বকে একটি নতুন স্তর দেখা যায় এবং ১২o ঘণ্টা পরে ত্বকের ফোলাভাব হ্রাস পায় এবং ত্বকের উপরে নতুন স্তর দেখা যায়।
চিকিৎসাঃ
বেশিরভাগ ক্ষেত্রে চিকিৎসকের সহায়তা ছাড়াই ফোস্কার নিরাময় সম্ভব হয়। ফোস্কার তরল আস্তে আস্তে অদৃশ্য হয়ে যায় এবং ত্বক স্বভাবিক ভাবে শুকিয়ে যায় এবং খোসা ছাড়ায়। এটি কখনো ফাটানো বা গলানো উচিত নয়। কারণ, ফোস্কার তরল নিচের ত্বককে সংক্রমণ থেকে রক্ষা করে। এটি ছিঁড়ে ফেললে তরল বের হয়ে আসতে পারে এবং ত্বক সংক্রমিত হতে পারে। যদি হঠাৎ ফেটে বা গলে যায় তাহলে গজ দিয়ে ঢেকে রাখলে ত্বক অতিরিক্ত আঘাত থেকে রক্ষা পায় এবং দ্রুত নিরাময় যোগ্য হয়।
প্রতিরোধ ব্যবস্থাঃ
পায়ের ফোস্কা এড়ানোঃ আরামদায়ক জুতা এবং মোজা পরিধান করতে হবে। হাই হিল এড়িয়ে চলতে হবে। কারণ, হাই হিল পরলে ফোস্কা হওয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি থাকে। আর্দ্র ত্বকে ফোস্কা হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে, তাই পায়ের ঘাম হ্রাস করে এমন মোজা পরিধান করতে হবে।
হাতের ফোস্কা এড়ানোঃ খেলাধুলা বা ম্যানুয়ালি কোনো কাজ করার সময় হাতে গ্লাভস পরতে হবে।হাতকে ঘর্ষণ থেকে রক্ষা করার জন্য ট্যালকম পাউডার ব্যবহার করতে হবে।
ফোস্কা বেশ যন্ত্রণাদায়ক এবং সাধারণত এর কোনো তেমন কোনো প্রতিরোধ বা প্রতিকার নেই। তবে উপরের নিয়মগুলো অনুসরণ করলে এটি যেন না হয়, তার ব্যবস্থা করা সম্ভব।
আমেনা আঁখি/ নিজস্ব প্রতিবেদক
তথ্যসূত্রঃ হেলথলাইন, মেডিকেল নিউজ টুডে