দিল্লি সালতানাত পেরিয়ে মুঘল আমল, ব্রিটিশ আমল, পাকিস্তানি শাসন। সবশেষে আজকের বাংলাদেশ। সুদীর্ঘ ইতিহাসে সবসময়ই নদীবিধৌত এই অঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ নগর ছিল ঢাকা। পুরান ঢাকা থেকে শুরু করে অভিজাত অবকাঠামোর ঢাকার প্রভাব যেন এই দেশের মানুষের জীবনকালের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
এমনকি সাম্প্রতিক কিছু গবেষণা বলছে ঢাকার ইতিহাসের দৈর্ঘ্য বছরের হিসেবে চার শত নয় বরং দুই হাজারের উপরে! ইতিহাস ও ঐতিহ্যে প্রানোজ্জল এই শহরকে নিয়ে আছে নানান অভিযোগ ও অব্যবস্থাপনা।
সায়েন্স বী নিউজ টিমের ঢাকা সিরিজ এর ৩য় প্রতিবেনের প্রতিপাদ্য ‘আমার চোখে ঢাকা’। এত শত অভিযোগ, অনিয়ম, ভোগান্তি, দূষণ- এসব কিছু ছাপিয়ে এ শহরের এমন কোনো দিক কি আছে যা ঢাকাবাসীর কাছে প্রিয়? এই প্রশ্নের উত্তরই উঠে আসছে এবারের প্রতিবেদনে।
সায়েন্স বী’র আয়োজনে সায়েন্স বী বিজ্ঞান সংবাদ ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাব ‘লাস্ট নাইট স্কলার্স’ এর যৌথ টিমের সদস্যরা একই সাথে অনলাইন এবং অফলাইনে ঢাকাবাসীর মতামত সংগ্রহ করে। বিভিন্ন শ্রেণীপেশার মানুষের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল তাদের চোখে ঢাকার সুন্দর দিক কোনটি বা তারা কী আদৌ ঢাকার কোনো সুন্দর আঙ্গিক খুঁজে পান কিনা।
সেই লক্ষ্যেই মাঠপর্যায়ে মতামত নিতে সার্ভে টিম পৌঁছে গিয়েছিলো রাজধানীর নতুন বাজার, কুড়িল-বিশ্বরোড, মহাখালী, সদরঘাট এবং পুরান ঢাকার চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউতে। একই সাথে বৃহত্তর পরিসরে ঢাকার বিভিন্ন এলাকার মানুষের মতামত জানতে গুগল ফর্ম এর সাহায্য নেয়া হয়েছিলো। ব্যক্তিগত গোপনীয়তা রক্ষায় সায়েন্স বী এই প্রতিনবেদনে কারো পরিচয় প্রকাশে বিরত।
পুরো সার্ভেতে শহরের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মোট মতামত দিয়েছেন ১৩০ জন। তাদের মধ্যে–
৫০ জন শিক্ষার্থী, ২০ জন শিক্ষক/শিক্ষিকা ও ৬০ জন অন্যান্য পেশাজীবী (যাদের মধ্যে ছিলেন ব্যবসায়ী, সরকারি-বেসরকারি চাকরিজীবী, গৃহিণী, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, সাংবাদিক, আইনজীবী, ফুচকাওয়ালা, রিকশাওয়ালা, দোকানের কর্মচারী, রাইড শেয়ারার, পুলিশ)। এই ৬০ জন বিভিন্ন পেশাজীবীর মাঝে ২০ জন ছিলেন নিম্ন আয়ের বা সীমিত আয়ের পেশাজীবী।
ঢাকা কে নিয়ে সকলের নানান উত্তর ছিল। তবে অধিকাংশই বলেছেন ঢাকার সুযোগ সুবিধার কথা। আবার অনেকেই জাদুর শহরকে বেশ রোমান্টিসাইজ করে দেখেছেন। সায়েন্স বী বিজ্ঞান সংবাদের প্রতিবেদকেরা প্রাপ্ত উত্তরগুলো কিছু নির্দিষ্ট শ্রেণিতে তুলে ধরেছেন যা নিচে তুলে ধরা হলো-
পেশা / শ্রেণি |
ঢাকা শহরের সবচেয়ে সুন্দর দিক / বিষয় কী? |
শিক্ষার্থী |
সুযোগ সুবিধা : ৪৬% রোমান্টিসাইজঃ ২৮% নাইঃ ২৬% |
শিক্ষক / শিক্ষিকা |
সুযোগ সুবিধা : ৭৬% রোমান্টিসাইজঃ ২০% নাইঃ ৪% |
অন্যান্য পেশা |
সুযোগ সুবিধা : ৪৬% রোমান্টিসাইজঃ ২৮% নাইঃ ২৬% |
নিম্ন আয়ের পেশাজীবী |
ইনকাম : ৭০% সুযোগ সুবিধা : ২০% রোমান্টিসাইজঃ ২% নাইঃ ৮ % |
যারা সুযোগ সুবিধাকে প্রাধান্য দিয়েছেন তাদের মতামত ছিল শিক্ষা, চিকিৎসা, অবকাঠামো এসবে ঢাকা অনন্য।
অন্যদিকে যারা ঢাকাকে বেশ রোমান্টিসাইজ করে দেখেছেন তাদের উত্তরগুলো ছিল আকর্ষণীয়। যেমন, রোমান্টিসাইজ করে দেখা নাগরিকদের মধ্যে ১৭% বলেছেন ঢাকার নান্দনিক দিক হলো এর বৈচিত্র্য। তাদের চোখে বিচিত্র ঘড়নার মানুষের মিলন মেলা হলো ঢাকা।
অন্যদিকে ১৪% মানুষের চোখে ঢাকার ইতিহাস ও ঐতিহ্য সবচেয়ে সুন্দর দিক। বাকিদের উত্তরের মধ্যে ছিল ঢাকার খাবার, ঢাকার কোরবানির ঈদ, ঢাকার ব্যস্ততা, উৎসবের আমেজ, এমনকি জীবনের তাড়নায় নতুন সম্ভাবনার দুয়ার উন্মোচনে ঢাকামুখী জনস্রোতই ঢাকার নান্দনিক দিক।
কিন্তু কেন একই শহরের মানুষের উত্তরে এতো তারতম্য? এই প্রশ্নের উত্তরে দেখা যায় মানুষের অবস্থা, অবস্থান এমনকি আর্থসামাজিক পরিস্থিতি যে তার চিন্তাধারা ও মানসিকতায় প্রভাব ফেলে- যার বেশি স্পষ্ট চিত্র এই অনুসন্ধানে উঠে আসে।
অনুসন্ধানে যাওয়ার আগে বলে নিতে হয়- সায়েন্স বী থেকে এটি ‘ঢাকা সিরিজ’ এর তৃতীয় আয়োজন। ঢাকা শহরের দূষণ নিয়ে সায়েন্স বী নিউজ টিমের ঢাকা সিরিজ এর প্রথম পর্বে উঠে এসেছে ঢাকার জনজীবনে প্লাস্টিকের ভয়াবহ নেতিবাচক প্রভাব।
দূষণের পরপরই ঢাকা শহরের সবচাইতে বড় সমস্যা যার মুখোমুখি প্রায় প্রতিটি নাগরিককে নিয়মিত হতে হয় তা হলো ‘ট্র্যাফিক জ্যাম’। সায়েন্স বী বিজ্ঞান সংবাদ টিমের ঢাকা সিরিজের ২য় প্রতিবেদন ছিল ট্র্যাফিক জ্যাম নিয়ে। সেই প্রতিবেদনে ঢাকা শহরের ১০০ জনের উপর করা সার্ভে অনুযায়ী ট্র্যাফিক জ্যামের ফলে ঢাকাবাসীর মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাবের দিক উঠে আসে। সব মিলিয়ে দূষণ আর অব্যবস্থাপনায় ঢাকা শীর্ষে!
ঢাকা সিরিজ এর তৃতীয় আয়োজন ‘আমার চোখে ঢাকা’ সার্ভে-র যে ফলাফল সেখানে দেখা যায় মানুষের আর্থসামাজিক অবস্থান তাদের চিন্তাধারাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করছে। এই অনুসন্ধানে পাওয়া তথ্যমতে, ঢাকার সুন্দর দিক বলতে রাজধানীতে পাওয়া সুযোগ-সুবিধার কথা মনে করেন শিক্ষার্থীদের ৪৬%, শিক্ষক-শিক্ষিকাদের ৭৬% ও অন্যান্য পেশাজীবীদের মধ্যে ৪৬%।
কিন্তু নিম্ন বা সীমিত আয়ের মানুষের মধ্যে মাত্র ২০% বলেছেন ঢাকার সুযোগ সুবিধাই যে এর সুন্দর দিক, অথচ তাদের (নিম্ন আয়ের মানুষ) ৭০% মনে করেন ঢাকার ভালো দিক হলো এখানে চাকরি বা আয় রোজগারের বাড়তি সুযোগ! মজার বিষয় হলো, কাজের সুযোগ বেশি এমন ধরনের উত্তর অন্যান্য পেশাজীবীদের থেকে থেকে পাওয়া যায়নি। প্রশ্ন হলো, আয়ের ব্যবধানে কেন উত্তরের এতো তফাৎ! এর কোনো যৌক্তিক ব্যাখ্যা আছে কি?
আলবত আছে! তত্ত্বীয় ভাষায় এর ব্যাখ্যা দেয়া হয় পারসেপচুয়াল অ্যাকসেনচুয়েশন (Perceptual Accentuation) দ্বারা। এর মানে হলো- মানুষের মন যা চায়, যেটাকে গুরুত্ব দেয় বা প্রয়োজনীয় মনে করে সেটা তাদের চোখে/মনোভাবে একটু বেশিই বড় বা গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন। ১৯৪৭ সালে এই ধারণা সম্পর্কে প্রথম ধারণা দেন জেরোম ব্রুনার আর সেসিল গুডম্যান।
তাদের এই ধারণার পিছনে তারা শিশুদের দুইটি গ্রুপের উপর গবেষণা করেন। যেখানে একটি গ্রুপের শিশুরা তুলনামূলক কম আয়ের পরিবারের সন্তান অন্যদিকে অপর গ্রুপের শিশুরা ধনী পরিবারের। তাদের প্রত্যেককে বিভিন্ন আকারের কয়েনের ছবি এবং একই আকারে কাটা কার্ড-বোর্ডের ছবি পাশাপাশি দেখানো হয় এবং গবেষকরা জিজ্ঞেস করেন দুইটির মধ্যে কোনটি বড়।
শিশুদের উত্তরে দেখা যায় যে, সকল শিশুরা তুলনামূলক স্বল্প আয়ের পরিবারে বড় হয়েছে তারা কয়েন বা মুদ্রাগুলোকে বাস্তবে কাটা কার্ড-বোর্ডের চাইতে বড় মনে করে।কিন্তু কেন? এর উত্তর টাকা তাদের কাছে অনেক মূল্যবান, তারা এটিকে কার্ডবোর্ড থেকে বেশি প্রয়োজনীয় মনে করেন এবং গুরুত্ব দিতে চান। ফলে মস্তিষ্ক নিজের মতো করে সেটাকে বড় করে দেখে। অন্যদিকে, ধনী শিশুরা একই আকৃতির কয়েন ছোট বা কার্ড-বোর্ডটি সমান দেখছে বলে জানান, কারণ তাদের কাছে সেটা অতটা গুরুত্বপূর্ণ না।
সবার জীবনেই এই পারসেপচুয়াল অ্যাকসেনচুয়েশনের অভিজ্ঞতা কিন্তু প্রায়ই হয়। যেমন খুব ক্ষুধার্ত অবস্থায় খাবারের গন্ধ যেন আরও তীব্র মনে হয়, খাবারের ছবি যেন অনেক আকর্ষণীয় লাগে। আবার, সবসময়ই নিজের খুব কাছের বা পছন্দের মানুষের কথাবার্তা, হাসি বা তার ছোট ছোট কাজও অনেক বেশি অর্থপূর্ণ মনে হয়।
এবার আগের প্রশ্নে ফিরে যাওয়া যাক- কেন সায়েন্স বী’র গবেষণাতেও দেখা যাচ্ছে সিংহভাগ সীমিত আয়ের জনগোষ্ঠীর কাছে ঢাকার আকর্ষণীয় দিক হলো এখানের চাকরির প্রাচুর্য? এ প্রশ্নের উত্তরে সম্মুখীন হতে হয় একটি অপ্রিয় সত্যের। কাগজে কলমে বর্তমানে বাংলাদেশকে বলা হয় একটি “উন্নয়নশীল দেশ”। ২০২৩ সালের ২২শে জানুয়ারীতে প্রকাশিত Dhaka Tribune এর একটি প্রতিবেদনে বলা হয়,
বাংলাদেশ পোভার্টি ওয়াচ রিপোর্ট ২০২২ অনুযায়ী, প্রায় ৩.৫ কোটি মানুষ এখনও দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করছেন। গত তিন দশকে দারিদ্র্য হার কমলেও, দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করা মানুষের মোট সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পায়নি।
জাগোনিউজ২৪.কম এর ৩১শে অক্টোবর ২০২১ প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়,
“বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ও জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের (ইউএনএফপিএ) হিসাব অনুযায়ী প্রতি বছর ঢাকা শহরে ছয় লাখ ১২ হাজার মানুষ যুক্ত হয়, যা দিনে এক হাজার ৭০০। এই বিপুল জনসংখ্যার অধিকাংশই ঢাকায় আসেন কেবল জীবিকার তাগিদে। “
কবি বলেছেন, ‘ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়, পূর্ণিমার চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি’। অতিরঞ্জিত মনে হলেও এটাই সত্য যে পেটে ক্ষুধা নিয়ে থাকলে অন্য সব সমস্যাই তুচ্ছ। যে ব্যক্তি শুধু জীবিকার সন্ধানে তার পরিবার ছেড়ে এই ইট-পাথরের শহরে পাড়ি জমিয়েছেন তার কাছে খুবই স্বাভাবিক ভাবেই জাদুর শহরের আকর্ষণীয় দিক হিসেবে মনে হবে এখানের আয় রোজগারের সহজতা।
এক্ষেত্রে স্মরণে রাখা ভালো- স্বল্প আয়ের অধিকাংশ মানুষই দিনে এনে দিনে খান এবং তাদের প্রতিদিনের প্রধান চ্যালেঞ্জ হলো আজকের দিনের ৩ বেলার খাবার নিশ্চিত করা। তার কাছে এই মুহূর্তে শহরের সৌন্দর্য উপভোগ করা বা অবকাঠামোগত সুবিধার কথা ভাবা হলো বিলাসিতা।
অপরদিকে যারা তুলনামূলক ভাবে একটু ভালো আয় করেন তাদের কাছে কিছুটা ায় রোজগার বহির্ভূত বিলাসী জীবন চিন্তা ভাবনা করার সুযোগ আছে। সেজন্যই তাদের উত্তরে উঠে এসেছে রাজধানী হিসেবে ঢাকায় শিক্ষা, স্বাস্থ্য, আবাসন ইত্যাদি ক্ষেত্রে কি কি সুবিধা পাওয়া যায়।
ইতিহাস ও ঐতিহ্যের দিক থেকে ঢাকা কতটা সমৃদ্ধ, এ শহরের রাতের আকাশে স্ট্রিটল্যাম্পের আলো কতটা মনোরম বা শীতের সন্ধ্যায় ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপ হাতে আড্ডা দেয়া কতটা আনন্দের। জীবন দর্শনের এই বিস্তর ফারাক আসছে সেই পারসেপচুয়াল অ্যাকসেনচুয়েশনের কারণেই- যার কাছে যা গুরুত্বপূর্ণ, তার ভাবনায় সেটাই প্রকট!
দিনশেষে উন্নয়নশীল রাষ্ট্রের তকমা গায়ে লাগানো এই জনগোষ্ঠীর জন্য ঢাকা যেন সত্যিই অনন্য। ইতিহাস পরিক্রমার প্রতিটি মোড়ের কেন্দ্রবিন্দু ছিল এই নগরী। সংস্কৃতি থেকে ঐতিহ্য, শিল্প থেকে বাণিজ্য, ক্ষমতা থেকে নেতৃত্ব, সবই যেন এই ঢাকার বাতাসেই মিশে আছে। এই নগরী ঢাকাবাসীর নগরী। আর তাই এই নগরীর ভালো-মন্দও ঢাকাবাসীরই ভালোমন্দ। ঢাকাকে একটি সুন্দর এবং বসবাসযোগ্য নগরী করে তোলার দায়িত্ব তাই ঢাকাবাসীরই হাতে।
মতামত সংগ্রহেঃ মাইশা চৌধুরী, জুনায়েদ মোঃ পারভেজ হোসেন, মেরাজ আহম্মেদ, ইসরাত জাহান মুনা (ডিপার্টমেন্ট স্কলার /লাস্ট নাইট স্কলার্স ক্লাব, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়)
তথ্য বিন্যাসঃ তাহমিদুল ইসলাম অর্নব (নিজস্ব প্রতিবেদক /সায়েন্স বী নিউজ টিম)
অনুসন্ধান ও প্রতিবেদনঃ শাহলীন রাহনুমা, (রিসার্চ কোঅর্ডিনেটর /সায়েন্স বী নিউজ টিম)
পরিচালনায়ঃ জুম্মান আল সিয়াম (রিসার্চ কোঅর্ডিনেটর, সায়েন্স বী নিউজ টিম)
তথ্যসূত্র: সার্ভের এলাকা গুলো: নতুন বাজার, কুড়িল বিশ্বরোড, মহাখালী, সদরঘাট,