Curious Kids নামক বাচ্চাদের এক প্রোগ্রামে অড্রি নামের এক শিশু একটি মজাদার প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করে। তার প্রশ্নটি ছিলো: “আমরা কোন কিছুর গন্ধ কীভাবে পাই? মানুষের মতো করে কি AI ঘ্রাণ নিতে সক্ষম?”
শুনতে খুবই শিশুসুলভ হলেও এ প্রশ্ন আমাদের অনেকের মাথায়ই কোনো না কোনো সময়ে এসেছে। তবে বিজ্ঞানের আধুনিকায়নের পর, ধীরে ধীরে এ রহস্যময় ঘটনার পেছনের আসল কারণটা আমরা উদঘাটন করতে পারছি। সত্যি বলতে, আজও বিজ্ঞানীদের কাছে মানুষের এরূপ ভিন্ন ভিন্ন প্রকারের ঘ্রাণ নিতে পারার কারণসমূহ নির্ভূলভাবে ব্যাখ্যা করাটা বেশ জটিল একটা কাজ। তবে যতটুকু গবেষণা হয়েছে তার উপর ভিত্তি করে একটা মোটামুটি ধারণা দাঁড় করানো যায়।
আমরা মানুষেরা কোন কিছুর গন্ধ কিভাবে পাই?
যখন আমরা কোন জিনিসের গন্ধ নিয়ে থাকি, তখন প্রচুর অণু-পরমাণু আমাদের নিঃশ্বাসের সাথে নাকের ভেতর ঢুকে। নাকের যে ছিদ্র দুটি দিয়ে এগুলো ঢুকে, সে ছিদ্র দুটিকে নাসারন্ধ্র বলে। নাসারন্ধ্রের ভেতরে থাকা ফাঁকা অংশটিকে নাসাগহ্বর বলে। নাসাগহ্বরে ‘অলফ্যাক্টরি নিউরন’ নামক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কোষ অবস্থান করে (olfaction অর্থ ঘ্রাণ নেবার অনুভূতি)।
নিউরন বলতে ঐসব কোষকে বোঝায় যারা দেহ ও মস্তিস্কের মাঝে বার্তা আদানপ্রদান করে। সে হিসেবে অলফ্যাক্টরি নিউরন হলো ঐসব নিউরন, যারা দেহ ও মস্তিস্কের মাঝে ঘ্রাণ সম্পর্কিত তথ্যাদি সমূহ আদান-প্রদান করে। যখন বাইরে থেকে আমাদের নাসারন্ধ্র দিয়ে কোনো পদার্থ ঢুকে, নাসাগহ্বরে থাকা অলফ্যাক্টরি নিউরনগুলো পদার্থটিতে থাকা অণুগুলোর আণবিক গঠন দ্বারা সেটিকে শনাক্ত করে।
শনাক্তকরণের পর সে বার্তাটি নিউরনের মাধ্যমে মস্তিষ্কের অলফ্যাক্টরি গ্লোমেরুলি পর্যন্ত যায়। অলফ্যাক্টরি নিউরন কর্তৃক পাঠানো ভিন্ন ভিন্ন বার্তা মস্তিষ্কের ঐ অংশে ভিন্ন ভিন্ন প্রকারের বৈদ্যুতিক কার্যকলাপের সূত্রপাত ঘটায়। আর এই ভিন্ন ভিন্ন কার্যকলাপ গুলোকেই মস্তিষ্ক ভিন্ন ভিন্ন ঘ্রাণ হিসেবে শনাক্ত করে। ফলে আমরা ঐ নির্দিষ্ট পদার্থটির ঘ্রাণ পাই এবং ঘ্রাণটি দ্বারা আমরা পদার্থটিকে চিনতে পারি।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, AI কি মানুষের ন্যায় ঘ্রাণ নিতে সক্ষম?
গন্ধ শনাক্তকরণ মানুষের জন্য বেশ কঠিন একটা কাজ। অনেকক্ষেত্রে রং চেনার চেয়ে গন্ধ চেনা বেশি কঠিন। মানব দেহে রিসেপ্টর নামক কিছু বিশেষ প্রকারের প্রোটিন অণু থাকে। এই প্রোটিন অণুগুলো কোষের ভিতরে বা পৃষ্ঠে অবস্থানকারী নির্দিষ্ট পদার্থের অণুর সাথে আবদ্ধ হয় এবং কোষে সে অনুযায়ী নির্দিষ্ট সংকেত পাঠায়। অলফ্যাক্টরি নিউরন সমূহকেও মূলত অলফ্যাক্টরি রিসেপ্টরগুলো-ই সংকেত পাঠায়। মানুষের চোখে শুধুমাত্র তিন প্রকারের রিসেপ্টর থাকে যারা মূলত লাল, নীল, সবুজ রং সনাক্ত করে থাকে। কিন্তু নাকের ক্ষেত্রে আমরা প্রায় ৩০০ প্রকারের রিসেপ্টর দেখতে পাই। বেশি রিসেপ্টর থাকার অর্থ বেশি বেশি সংকেত নিয়ে কাজ করা, যা কাজটির জটিলতা অনেকাংশে বৃদ্ধি করে।
কিন্তু এখন যদি কেউ দাবি করে বসে, প্রকৃতির জটিল এই কাজ আমরা চাইলে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে সম্পাদন করতে পারি, তাহলে বিষয়টা কেমন দাঁড়ায়? সাম্প্রতিক সময়ে এমনটাই কিন্তু করার চেষ্টা করেছে Google। Google AI একটি ‘Odor map’ তৈরি করেছে যা পদার্থের আণবিক গঠন সম্পর্কিত তথ্যাদি সংগ্রহ করে সেটির ঘ্রাণ কেমন হতে পারে তা বলে দিতে পারে।
এখন ‘Odor map’ কী?
এটি একটি প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে ঘ্রাণ সম্পর্কিত তথ্যাদিগুলোর একটি দৃশ্যমান উপস্থাপনা করা হয়। একে আমরা ‘Color map’ এর সাথেও তুলনা করতে পারি। ‘Color map’ এ গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন তথ্য ও উপাত্তকে নানা ধরনের রঙয়ের মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়। ফলে জটিল তথ্য ও উপাত্তগুলোর আমরা একটি সহজ দৃশ্যমান উপস্থাপনা পাই। এ প্রযুক্তি ব্যবহার করে একটি নির্দিষ্ট পদার্থ ঠিক কোন ধরনের ঘ্রাণ দিবে, তা AI নির্ণয় করতে পারে।
এ পরীক্ষায় পূর্বে AI model টিকে প্রায় ৫০০০ ধরনের অণু এবং অণুগুলো সম্পর্কিত প্রচুর উপাত্ত দিয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। একইসাথে, কমপক্ষে ১৫ জন প্রশিক্ষিত অংশগ্রহণকারীর একটি প্যানেলকে বিভিন্ন নমুনা দিয়ে, নমুনাগুলোর গন্ধ সম্পর্কে মতামত দিতে বলা হয়। পরবর্তীতে তাদের দেয়া সম্মিলিত গড় মতামতের সাথে AI model টির দেয়া ফলাফল মিলিয়ে দেখা হয়। দেখা যায় যে, প্রায় ৫৩% ক্ষেত্রে AI এর দেয়া ফলাফল ও প্যানেলের দেয়া গড় ফলাফল প্রায় কাছাকাছি।
যদিও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার জগতে এটি বেশ বড় একটি মাইলফলক, তবুও এটিও সত্য AI model টির এখনো প্রচুর সীমাবদ্ধতা রয়েছে। যেমন: AI model টি একক অণুর ঘ্রাণ নির্ণয় করতে পারলেও যখন একে কোন মিশ্র ঘ্রাণ দেয়া হয় তখন এটি সঠিকভাবে ফলাফল দিতে পারে না। আর বাস্তব জীবনে গন্ধগুলো মিশ্র আকারেই থাকে।
উক্ত সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও এ গবেষণা ভবিষ্যতে আমাদের জন্য উপকারী প্রমাণিত হবে এমনটা আশা রাখাই যায়। বিশেষ করে পারফিউম শিল্পের মতো ক্ষেত্র সমূহে এটি ব্যবহার করা গেলে, পণ্যের গুণগত মান অনেকাংশে বৃদ্ধি করা সম্ভব।
আতিক হাসান রাহাত/ নিজস্ব প্রতিবেদক
তথ্যসূত্র: ScientificAmerican, IndiaAi, MIDCD.NIH.GOV, TheConversation