আমরা সাধারণত জানি যে ভ্রূণ জরায়ুতে বেড়ে ওঠে। কিন্তু আজ সোশ্যাল মিডিয়ায় একটি খবর ঘুরে বেড়াচ্ছে যে, “ জরায়ুতে নয়, লিভারের ভিতরে বেড়ে উঠছিল ভ্রূণ!” এখানে এক দেখায় অনেকেই মনে করতে পারেন এটা বাংলাদেশের ঘটনা। কিন্তু না, এই ঘটনা ঘটেছে ভারতে। বুলন্দশহরের ৩৫ বছরের সর্বেশের ক্ষেত্রে জরায়ুর বদলে লিভারে ভ্রূণ বেড়ে উঠতে দেখা গিয়েছে। এই ঘটনা বিশেষজ্ঞদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষের মধ্যেও ব্যাপক কৌতূহল তৈরি করেছে।
তিন মাস যাবত সর্বেশের শারীরিক অবস্থা খারাপ ছিল। সে অনিয়ন্ত্রিতভাবে বমি করছিল। সব সময় ক্লান্ত থাকতো, ভীষণ যন্ত্রণা হতো। তার কী হয়েছে সে এবং তার পরিবার কিছুই বুঝতে পারছিলো না। অবস্থার আরো অবনতি হতে শুরু করলে চিকিৎসক তাকে আলট্রাসোনোগ্রাফি করানোর পরামর্শ দেন। কিন্তু তাতেও কিছু জানা যায়নি। মাসখানেক ওষুধ খাওয়ার পরে যখন তার স্বাস্থ্যের কোনো উন্নতি দেখা যাচ্ছিলো না তখন তিনি দ্বিতীয়বার আলট্রাসোনোগ্রাফি করান। সে রিপোর্টে যা আসে তা চিকিৎসকদেরও বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল। ‘আপনার লিভারে ভ্রূণ রয়েছে’। সর্বেশের পক্ষে বিষয়টা বিশ্বাস করা অসুবিধাজনক ছিল কারণ তার মাসিক চক্র স্বাভাবিকভাবেই চলছিল।
ওই নারীর লিভারের ডান পাশে ১২ সপ্তাহের প্রেগনেন্সি লক্ষ্য করা যায়, যার মধ্যে কার্ডিয়াক পালসেশন বা হৃদস্পন্দন স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান ছিল।
লিভারে ভ্রূণ বেড়ে ওঠায় জীবনঝুঁকি থাকায় চিকিৎসকরা জানান, ভ্রূণ বড় হলে লিভার ফেটে মা-শিশু দু’জনকেই বাঁচানো যাবে না, তাই অস্ত্রোপচারই একমাত্র উপায়। স্থানীয় ও মিরাটের চিকিৎসকরা প্রথমে কেস নিতে রাজি হননি এবং দিল্লি যাওয়ার পরামর্শ দেন, কিন্তু গরিব হওয়ায় পরিবার তা পারেনি। শেষমেশ মিরাটের এক বেসরকারি হাসপাতালে ডা. পারুল দাহিয়া, সিনিয়র সার্জন ডা. সুনীল কানওয়াল ও টিম দেড় ঘণ্টার অস্ত্রোপচারে ভ্রূণ অপসারণ করেন, যা আল্ট্রাসনোগ্রাফি ও এমআরআই রিপোর্টে ইন্ট্রাহেপ্যাটিক অ্যাক্টোপিক প্রেগনেন্সি হিসেবে ধরা পড়ে।
মূলত এই অবস্থাকে ইন্ট্রাহেপ্যাটিক একটোপিক প্রেগনেন্সি বলা হয়, যা একেবারেই বিরল। সাধারণত, একজন নারী তখন গর্ভধারণ করেন যখন ডিম্বাশয় থেকে নিঃসৃত ডিম্বাণু শুক্রাণু দ্বারা নিষিক্ত হয়। এই নিষিক্ত ডিম্বাণু ফ্যালোপিয়ান টিউবের মধ্য দিয়ে জরায়ুর দিকে চলে যায়। তারপর জরায়ুতেই ভ্রূণের বিকাশ হতে থাকে। কিন্তু ইন্ট্রাহেপ্যাটিক একটোপিক প্রেগনেন্সির ক্ষেত্রে তার ব্যতিক্রম দেখা যায়। এই বিশেষ ক্ষেত্রে নিষিক্ত ডিম্বাণু জরায়ুতে পৌঁছানোর বদলে ফ্যালোপিয়ান টিউবে থেকে যায় বা অন্যান্য অঙ্গের পৃষ্ঠে লেগে থাকে। যেমন সর্বেশের ক্ষেত্রে লিভারে ভ্রূণ দেখা গিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে প্রচুর রক্তক্ষরণ হতে পারে। এই কারণে সর্বেশের ঋতুস্রাব স্বাভাবিক রয়েছে বলে মনে করতে থাকেন এবং তিনি যে গর্ভবতী তাও বুঝতে সময় লাগে। ডা. মমতার মতে, লিভারের ভালো রক্তসরবরাহে শুরুতে ভ্রূণ বেড়ে উঠলেও পরে মা-শিশুর জন্য মারাত্মক ঝুঁকি তৈরি হয়, তাই অস্ত্রোপচারই একমাত্র উপায়।
অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অফ মেডিকেল সায়েন্সেস, পাটনার প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিভাগের অধ্যাপিকা ডা. মনিকা অনন্তের মতে, গোটা বিশ্বে গড়ে মাত্র এক শতাংশ ইন্ট্রাহেপ্যাটিক অ্যাক্টোপিক প্রেগনেন্সির কেস দেখা যায়। এই সমস্ত ক্ষেত্রে জরায়ুর বদলে ভ্রূণ অন্যত্র দেখা যায়। তিনি জানিয়েছেন, বুন্দেলশহরের বাসিন্দা সর্বেশের আগে, সারা বিশ্বে ৪৫টা ইন্ট্রাহেপ্যাটিক অ্যাক্টোপিক প্রেগনেন্সির কেস রিপোর্ট করা হয়েছিল। এর মধ্যে তিনটে ঘটনা ভারতের।