মৌমাছি মৌমাছি কোথা যাও নাচি নাচি, দাঁড়াও না একবার ভাই!
সৃষ্টি জগতে সবচেয়ে কর্মঠ প্রাণী হিসেবে পিঁপড়ার পরেই মৌমাছির স্থান। কখনও মধু খেয়েছেন? প্রশ্নটা হাস্যকর। মধুর সাথে পরিচিত নয় এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দায়। কিন্তু অনেকেই এই মধু সংগ্রহের পিছনে মৌমাছির আত্মত্যাগ অজান্তেই উপেক্ষা করেন। নিজের জীবনচক্রে একটি মৌমাছি মাত্র দেড় চামচ পরিমাণ মধু সংগ্রহ করে। আর সেই মধু আমরা কিছু বিশেষ চকচকে কাগজের (টাকা) বিনিময়ে কেজি দরে কিনি। মৌমাছির জীবনচক্র নির্ধারিত হয় তার কর্মের মাধ্যমে।
প্রায় ২০,০০০ প্রজাতির মৌমাছি রয়েছে বর্তমান পৃথিবীতে। মৌমাছিদের মধ্যে অন্যতম হলো বাম্বাল বি। বর্ণশিক্ষা বইয়ে যাকে অ-তে “অলি” বলা হয়। বোম্বাস গণের প্রাণীটি ‘কৃষকের বন্ধু’ নামে খ্যাত। কারণ এই প্রজাতিটি তার লোমশ দৈহিক গড়নের জন্য, অন্যান্য মৌমাছির চেয়ে পরাগায়নে অধিক ভূমিকা রাখে।
সম্প্রতি কানাডার ইউনিভার্সিটি অফ গুয়েলফে করা এক গবেষণায় জানা যায়, বৈশ্বিক উষ্ণায়নের অর্থাৎ, এল-নিনোর প্রভাবে বাম্বাল বি-র মৌচাকের, শিশু বাম্বাল বি (অলি) তাদের অস্তিত্ব হারাচ্ছে।
একটি মৌচাকে তিন ধরনের মৌমাছি থাকে- ১) রাণী মৌমাছি, ২) কর্মী মৌমাছি ও ৩) পুরুষ মৌমাছি। এর মধ্যে কর্মী মৌমাছিরা মধু সংগ্রহ করে এবং একইসাথে ফুলের পরাগরেণু তাদের শরীরে লেগে উদ্ভিদ জগতের অন্যতম প্রক্রিয়া পরাগায়ন ঘটায়। রাণী ও পুরুষ মৌমাছি মৌচাকে অবস্থান করে ও পুরুষ মৌমাছিদের দ্বারা নিষিক্ত হয়ে বংশবৃদ্ধি করে।
শিশু মৌমাছিরা লার্ভা হিসেবে মৌচাকে অবস্থান করে। গবেষণায় তারা দেখতে পান যে, অলিদের বেঁচে থাকা এবং বিকাশের জন্য একটি উপযুক্ত তাপমাত্রা রয়েছে। লার্ভাদের জন্য চাকের আদর্শ তাপমাত্রা, ৮২.৪ থেকে ৮৯.৬ ডিগ্রি ফারেনহাইট (২৮-৩২ ডিগ্রি সেলসিয়াস) এর মধ্যে।
গবেষণার মূল উদ্দেশ্য ছিল, জলবায়ু পরিবর্তন দীর্ঘদিন ধরে তাপমাত্রার প্রতি সংবেদনশীল প্রাণীদের উপর কেমন প্রভাব ফেলছে তা পর্যবেক্ষণ করা। এটি কীভাবে বাম্বাল বি-দের প্রভাবিত করে তা পরিমাপ করতে, গবেষকরা তাদের উপর করা বিগত ১৮০ বছরের গবেষণা বিশ্লেষণ করেছেন।
এই গবেষণার গুরুত্বের উপর জোর দিতে, গবেষণার প্রধান লেখক ড. পিটার কেভান বলেছেন,
“এতদিন ধরে মৌচাকের উপর উচ্চ তাপমাত্রার প্রভাব খুব বেশি অধ্যয়ন করা হয়নি, যা ভীষণ আশ্চর্যজনক।”
তিনি আরও বলেন,
“এটি উল্লেখযোগ্য যে উচ্চ আর্কটিক থেকে গ্রীষ্মমন্ডল পর্যন্ত সমস্ত পথ, বাম্বলবিদের বাসায় পরিমিত তাপমাত্রার প্রয়োজনীয়তা একই ধরনের বলে মনে হচ্ছে।”
যাইহোক, সমস্যাটি ঘটে তখন, যখন চাকের তাপমাত্রা ৯৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট (৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস) ছাড়িয়ে যায়। যদিও বাম্বল বিদের শরীরের তাপ নিয়ন্ত্রণ করার জন্য একটি উল্লেখযোগ্য ক্ষমতা থাকে, তবে এই তাপ নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা তাদের চারপাশের পরিবেশ অনুযায়ী প্রসারিত হয় না।
এরই পরিপ্রেক্ষিতে কেভান যোগ করেন,
“আমরা অনুমান করতে পারি যে ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে চাকের উপরে তাপমাত্রার প্রভাব সম্ভবত অত্যন্ত ক্ষতিকারক হবে। প্রায় ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের উপরে মৌমাছিদের মৃত্যু ঘটবে এবং সম্ভবত খুব দ্রুতই তা ঘটবে।”
গবেষণায় আরও দেখা গেছে যে মৌমাছিরা এই গুরুত্বপূর্ণ তাপমাত্রায় তাদের প্রজনন করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে, যা তাদের অস্তিত্ব সংকটে ফেলতে পারে। এছাড়াও, গরমে বাসাগুলোতে বিকাশমান লার্ভা (বাচ্চা মৌমাছি) এর জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর পরিস্থিতি হয়ে ওঠে। যদিও কিছু বাম্বাল মৌমাছি তাপ সহ্য করে টিকে থাকতে পারে, তবে শিশু মৌমাছিদের জন্য তাপমাত্রা সংবেদনশীলতা তীব্র হতে পারে।
একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে,
“কিন্তু যদি বাসাটি সুস্থ লার্ভাদের জন্য খুব উষ্ণ হয়, তবে তা পুরো উপনিবেশের পক্ষে ক্ষতিকারক হতে পারে।”
এটা লক্ষণীয় যে বাম্বাল বীরা তাদের ডানা ঝাপটায়ে বাসা ঠান্ডা রাখতে ও তাদের বাচ্চাদের রক্ষা করার চেষ্টা করেন। কিন্তু বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির সাথে সাথে এই প্রাকৃতিক প্রতিরক্ষা ভেঙে যেতে পারে বলে বিজ্ঞানীরা আশঙ্কা করছেন। কেভানের মতে, শীতল তাপমাত্রার চেয়ে অতিরিক্ত উচ্চ তাপমাত্রা বেশিরভাগ প্রাণী ও উদ্ভিদের জন্য বেশি ক্ষতিকর।
তিনি ব্যাখ্যা করেন,
“যখন পরিস্থিতি শীতল হয়, তখন যে জীবগুলো বিপাকীয়ভাবে তাদের শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে না, তাদের বিপাকীয় প্রক্রিয়াগুলো কেবল ধীর হয়ে যায়। কিন্তু যখন তাপমাত্রা খুব বেশি হয়, তখন বিপাকীয় প্রক্রিয়াগুলো ভেঙে যেতে শুরু করে এবং একপর্যায়ে বন্ধ হয়ে যায়। ফলস্বরূপ, মৃত্যু দ্রুত ঘটে।”
গবেষণার পরবর্তী প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, সারা বিশ্বে ২৫০ টিরও বেশি বাম্বালবি প্রজাতি রয়েছে। তবে এই সংখ্যা হ্রাস পেতে পারে। ইউএস ফরেস্ট সার্ভিস জানিয়েছে যে শুধুমাত্র দেশে পাওয়া ৪৯ টি বাম্বালবি প্রজাতির মধ্যে দুইটি ইতিমধ্যে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। তার পাশাপাশি, এই ক্রমবর্ধমান বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি বাম্বাল বীদের জন্য কাটিয়ে ওঠা বিশেষভাবে কঠিন সমস্যা হিসেবে উঠে এসেছে।
“অতিরিক্ত তাপ স্পষ্টতই বেশিরভাগ প্রজাতির মৌমাছির জন্য একটি প্রধান সমস্যা,” গবেষণায় উপসংহারে বলা হয়েছে।
মৌমাছি এমন এক প্রাণী, যার থেকে নিঃস্বার্থতার প্রকৃত শিক্ষা লাভ করা যায়। তাদের বিলুপ্তি শুধুমাত্র পরিবেশের সামঞ্জস্যতার বিনষ্টের লক্ষণই নয়, তার পাশাপাশি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য জীবন্ত চারিত্রিক উদাহরণের জন্যেও হুমকি স্বরূপ।
কৃষ্ণ দেবনাথ / অতিথি প্রতিবেদক
তথ্যসূত্রঃ ইন্টারেস্টিং ইঞ্জিনিয়ারিং