বর্তমানে বিশ্বব্যাপী ডায়াবেটিস একটি অত্যন্ত গুরুতর রোগ হিসাবে পরিচিত। ডায়াবেটিস হলো শরীরের এমন একটি অবস্থা, যখন আমাদের শরীর নিজে থেকে ইনসুলিন তৈরি করতে পারে না বা তৈরি হওয়া ইনসুলিন রক্তে গ্লুকোজ এর মাত্রা নিয়ন্ত্রণে কাজ করতে পারে না। এর ফলে রক্তে শর্করার বা গ্লুকোজের মাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি হয়ে যায়। বিশ্বজুড়ে লাখ লাখ মানুষ এই রোগে আক্রান্ত এবং তাদের মধ্যে অনেকেই বাহ্যিক ভাবে ইনসুলিন গ্রহণ করেন।
ইনসুলিন হলো একটি গুরুত্বপূর্ণ হরমোন যা খাদ্য থেকে গ্লুকোজকে শরীরের কোষে প্রবাহিত করতে এবং গ্লুকোজকে শক্তিতে রূপান্তরিত করতে সহায়তা করে রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করে। ২০২১ সালে, যুক্তরাষ্ট্রে ৩.৬ মিলিয়ন প্রাপ্তবয়স্ক ডায়াবেটিস রোগী প্রথম রোগ নির্ণয়ের এক বছরের মধ্যে ইনসুলিন গ্রহণ করেছেন।
বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে ইনসুলিনের চাহিদা বেড়ে চলেছে, কিন্তু ইনসুলিনের দাম অনেক বেশি হওয়ার কারণে অনেক রোগী তাদের প্রয়োজনীয় ইনসুলিন গ্রহণ করতে সক্ষম হন না। এই পরিস্থিতিতে, গবেষকরা ইনসুলিন উৎপাদনের পদ্ধতিকে আরও উন্নত করার জন্য গবেষণা করছেন, যাতে এটি আরও সহজলভ্য হতে পারে।
এ বিষয়ে একটি বড় সাফল্য অর্জন করেছেন গবেষকরা, যাদের নেতৃত্ব দিচ্ছেন ড. ম্যাথিউ বি. হুইলার, যিনি ইউনিভার্সিটি অফ ইলিনয় আরবান ক্যাম্পেইন এর জিন প্রযুক্তি ও উন্নয়নশীল জীববিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক। সম্প্রতি তারা একটি জেনেটিক্যালি মডিফাইড গাভি তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন, যার দুধে মানব ইনসুলিন উৎপন্ন হবে। এই গবেষণা “বায়োটেকনোলজি জার্নাল”-এ প্রকাশিত হয়েছে এবং এটি ইনসুলিনের সরবরাহের বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার একটি সম্ভাব্য সমাধান হিসাবে দেখা হচ্ছে।
ক্রিস্টিয়ানা কেয়ারের জিন এডিটিং ইনস্টিটিউটের প্রধান গবেষক ড. ব্রেট এম. স্যান্সবারি মন্তব্য করেছেন,
“জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মাধ্যমে রোগের নির্ণয় এবং এর চিকিৎসায় উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সম্ভব। এই গবেষণা এক্ষেত্রে মানব স্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য এক মাইলফলক হয়ে থাকবে।”
গবেষণায়, গবেষকরা লক্ষ্য করেছিলেন যে কিছু জিনগত পরিবর্তন গাভির দুধে প্রোইনসুলিন উৎপাদন করতে সক্ষম কিনা। গবাদি পশুদের দুধ উৎপাদনের ক্ষমতা তুলনামূলক বেশি থাকে, যা ইনসুলিনের উৎপাদনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। গবেষকরা সেল নিউক্লিয়ার ট্রান্সফার প্রক্রিয়া (দাতা কোষের নিউক্লিয়াস থেকে একটি নিউক্লিয়াসবিহীন ডিম্বাণু কোষে প্রবেশ করিয়ে পরিবর্তিত ভ্রূণ তৈরির মাধ্যমে ক্লোন তৈরি করার একটি ল্যাবরেটরি প্রক্রিয়া) ব্যবহার করে বিশেষায়িত ভ্রূণের সৃষ্টি করেন, যাতে গাভির স্তন্যপান গ্রন্থিগুলোতে ইনসুলিন উৎপাদনের জন্য নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
গবেষকরা একাধিক ট্রান্সজেনিক ভ্রূণ (জেনেটিক্যালি মডিফাইড) তৈরি করতে সক্ষম হন এবং একটি ট্রান্সজেনিক গাভি তৈরি করেন। এরপর তারা গাভিটি গর্ভধারণ করতে সক্ষম কিনা তা পরীক্ষা করে দেখেন, এবং গাভিটি গর্ভধারণে সফল হয়নি। শেষ পর্যন্ত, গাভিকে হরমোনালভাবে দুধ উৎপাদনের জন্য উদ্দীপ্ত করা হয়। ২১ দিনের ল্যাকটেশনের পর, ৩০ দিনের জন্য দুধ সংগ্রহ করা হয় এবং সেখান থেকে ইনসুলিনের উপস্থিতি পরীক্ষা করা হয়।
গবেষণায় প্রাপ্ত দুধের রাসায়নিক বিশ্লেষণ থেকে দেখা গেছে যে, এতে মানব প্রোইনসুলিন এবং ইনসুলিনের মতো অনুরূপ আণবিক ভরের প্রোটিন রয়েছে। এছাড়াও, এটি ইঙ্গিত দেয় যে গাভির দুধ সম্ভবত প্রোইনসুলিনকে ইনসুলিনে রূপান্তরিত করতে সক্ষম হয়েছে।
“আমরা গাভির দুধে কার্যকর মানব ইনসুলিন উৎপাদনে সক্ষম হয়েছি,” বলেন ড. ম্যাথিউ বি. হুইলার। “উভয় গাভিই, প্রোইনসুলিন এবং ইনসুলিন উৎপাদন করছে, যা ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য একটি অর্থনৈতিক উৎস হিসেবে কাজ করতে পারে।”
তবে, এই গবেষণার কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। প্রথমত, সম্পূর্ণ জিনগত পরিবর্তনের প্রক্রিয়ায় মাত্র একটি গাভি সফলভাবে ইনসুলিন উৎপাদন করেছে। গবেষকরা শুধু দুধের একটি নির্দিষ্ট অংশ বিশ্লেষণ করেছেন, যা দ্রবীভূত প্রোটিনের অন্তর্ভুক্ত। এটি এখনও পরিষ্কার নয় যে কোন এনজাইমগুলো প্রোইনসুলিনকে ইনসুলিনে রূপান্তরিত করতে সাহায্য করে।
গবেষক ড. স্প্লেন্সার মন্তব্য করেছেন,
“গাভির দুধে সম্পূর্ণ কার্যকারিতা সম্পন্ন ইনসুলিন উৎপন্ন করাই গবেষকদের কাছে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। ট্রান্সজেনিক প্রাণীরা প্রায়ই গর্ভবতী হতে অসুবিধা ভোগ করে। গবেষকরা গাভিকে হরমোনালভাবে উদ্দীপ্ত করেছেন, যা ছোট পরিমাণে ইনসুলিন সমৃদ্ধ দুধ উৎপাদন করেছে। যদিও গবেষকরা ইনসুলিনের উপস্থিতি নিশ্চিত করেছেন, তারা এই ইনসুলিনের কার্যকারিতা প্রমাণ করতে পারেননি।”
যদিও উৎপাদনের পরিমাণ অনেক কম ও সময়সাপেক্ষ ছিল, গবেষকরা বিশ্বাস করেন যে এই পদ্ধতিটি আরও উন্নত ও সহজলভ্য করতে পারলে ভবিষ্যতে ইনসুলিন উৎপাদনে বিশাল সম্ভাবনা তৈরি হবে।
ভবিষ্যতের সম্ভাবনা
এই গবেষণা নিশ্চিতভাবে ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য একটি স্থিতিশীল এবং সম্ভবত আরও সাশ্রয়ী মূল্যের ইনসুলিন সরবরাহের নতুন পথ তৈরি করে দিয়েছে। বৈশ্বিকভাবে, ডায়াবেটিসের চিকিৎসায় ইনসুলিনের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম, এবং এই নতুন পদ্ধতি তার জোগান দিতে সাহায্য করতে পারে।
গবেষকরা জানান, যদি এই পদ্ধতি সফলভাবে স্কেল আপ (আরও উন্নত) করা যায়, তবে এটি শুধু ডায়াবেটিস রোগীদের জন্যই নয়, বরং বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উপর একটি ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে যেখানে ইনসুলিনের জোগান সীমিত, সেখানে এটি একটি বিপ্লবের মতো কাজ করবে।
তবে গবেষকদের অবশ্যই জিনগত পরিবর্তিত গবাদি পশু উৎপাদনের পাশাপাশি উক্ত প্রাণীদের নিরাপত্তার বিষয়টিও খেয়াল রাখতে হবে। “একদিন আমরা হয়তো দুধকে মানব রোগীদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ মেডিক্যাল প্রোটিনের উৎস হিসেবে ব্যবহার করতে পারব এবং ইনসুলিনকে ইনজেকশন ছাড়াই ডায়াবেটিস রোগীদের কাছে পৌঁছে দিতে সক্ষম হবো,” ড. হুইলার মন্তব্য করেন। “তবে, এটি একটি দীর্ঘ পথ, এবং আমাদের আরও অনেক গবেষণা চালিয়ে যেতে হবে।”
এটি সুস্পষ্ট যে, গবেষণার এই নতুন দিগন্তে আমাদের সামনে অনেক সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। ডায়াবেটিসের বিরুদ্ধে এই গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি নিশ্চিতভাবেই আশা এবং আশাবাদ নিয়ে আসবে কোটি কোটি মানুষের জীবনে।
এই গবেষণা ভবিষ্যতের চিকিৎসা বিজ্ঞানের এক নতুন অধ্যায় উন্মোচন করতে পারে, যেখানে প্রযুক্তি এবং জীববিজ্ঞান একত্রিত হয়ে মানবতার কল্যাণে কাজ করবে।
আমিনুল ইসলাম সিয়াম / নিজস্ব প্রতিবেদক
তথ্যসূত্র: এনডিটিভি.কম, মেডিকেল নিউজ টুডে