পৃথিবীতে এমন অনেক মানুষ আছে যারা ছোট থেকে বড় অনেক বিষয় ভুলে যায়। ভুলে যাওয়া বার্ধক্যের একটি স্বাভাবিক বিষয় মনে হলেও মূলত এটি আলজেইমার এর মতো কঠিন রোগের একটি লক্ষণ। Alzheimer’s disease– একটি স্নায়বিক অবক্ষয়মূলক রোগ, সহজভাবে বলতে গেলে ভুলে যাওয়া রোগ যা বার্ধক্যজনিত কারণে হয়ে থাকে। পুরো পৃথিবীতে প্রায় ৪ কোটিরও বেশি আলজেইমার রোগী আছে।
গবেষণায় দেখা গেছে, অ্যামাইলয়েড বিটা (সংক্ষেপে এ-বিটা) নামক এক ধরনের পেপটাইড আলজেইমার এর জন্য দায়ী। যা মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষ নিউরনের সংযোগ রক্ষাকারী সিন্যাপস ধ্বংস করে। ফলে মস্তিষ্কের কার্যকরিতা দ্রুত কমতে শুরু করে, বিশেষ করে মনে রাখার ক্ষমতা।
মস্তিষ্কে যখন অ্যামাইলয়েড বিটা অতিরিক্ত উৎপাদন হয়ে যায়, তখন এসব একত্রে জমাট বাঁধতে শুরু করে। এতে করে একটি অস্বাভাবিক গঠন তৈরি হয়; যাকে অ্যামাইলয়েড প্লেক বলা হয়। এই প্লেক গুলো আলজেইমার সহ অন্যান্য ডিমেনশিয়া রোগের বৃদ্ধি-বিকাশের সাথে সম্পর্কিত বলে জানা গেছে।
তবে সম্প্রতি জানা গেছে, একই ধরনের অ্যামাইলয়েড বিটা পেপটাইড মানুষের যকৃতে উৎপন্ন হয়ে তা যকৃতে কিছু উপকারি প্রভাব ফেলে।
যকৃত শরীর থেকে অন্যান্য বিষাক্ত পদার্থের মতো অ্যামাইলয়েড বিটা অপসারণ করে, কিন্তু একইসাথে যকৃত নিজের জন্য উপকারি প্রভাব যুক্ত অ্যামাইলয়েড বিটা উৎপন্ন করে। গবেষকের মতে যকৃত থেকে উৎপন্ন অ্যামাইলয়েড বিটা রক্তপ্রবাহের সাথে প্রবাহিত হয়ে যকৃতে একটি স্বাস্থ্যকর পরিবেশ বজায় রাখতে সাহায্য করে।
যেহেতু মস্তিষ্ক ও যকৃতে উভয় জায়গায়ই অ্যামাইলয়েড-বিটা উৎপন্ন হয় তাই দুটি উৎস থেকে এই প্রোটিনকে আলাদা করা কিছুটা চ্যালেঞ্জিং। এজন্য গবেষকরা ইঁদুরের উপর পরীক্ষা করে এই বিষয়টি নিশ্চিত হয়েছেন। তারা ইঁদুরের উপর এমনভাবে পরীক্ষা করেছেন যাতে শুধুমাত্র যকৃত কোষ থেকে মানুষের মতো অ্যামাইলয়েড বিটা তৈরি করে এবং তারা এই চ্যালেঞ্জ অতিক্রম করতে পেরেছেন।
তারা দেখলেন ইঁদুরের শরীরে নিউরোডিজেনারেশন এবং ব্রেইন অ্যাট্রোফির সাথে নিউরোভাস্কুলার প্রদাহ ও কর্মহীনতা তৈরি হয়েছে যা আলজেইমারে দেখা যায়। এই পরীক্ষা থেকে জানা যায় যকৃত কোষে তৈরি হওয়া অ্যামাইলয়েড-বিটা মস্তিষ্কে এমন রোগ সৃষ্টির জন্য দায়ী।
কিন্তু একই ধরনের প্রোটিন মানব শরীরের দুই অঙ্গে দুই ধরনের প্রভাব ফেলে কেন?
গবেষণায় দেখা যায়, সুস্থ মানুষ ও ইঁদুরের লিভার অ্যামাইলয়েড বিটা সমৃদ্ধ থাকে। কিন্তু দীর্ঘস্থায়ী যকৃতের রোগ বা লিভার সিরোসিসের ফলে যকৃতে অ্যামাইলয়েড বিটার পরিমাণ অনেকটা কমে যায়।
লিভার সিরোসিসে হেপাটোসাইট (যকৃত কোষ) গুলো তাদের কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলে এবং মারা যায়। ফলে যকৃত কোষগুলো অ্যামাইলয়েড বিটা উৎপন্ন করা এবং এদের ভাঙন বন্ধ করে দেয়। লিভার ফাইব্রোসিস (সিরোসিস এবং ক্যান্সারের প্রাথমিক পর্যায়) ক্রমশ সিরোসিস এবং ক্যান্সারে রুপান্তর হয়। গবেষকদের প্রাথমিক অনুসন্ধান থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন অ্যামাইলয়েড বিটার প্রভাব কাজে লাগিয়ে ফাইব্রোসিস প্রতিরোধ করা যেতে পারে। লিভার ফাইব্রোসিস এর শঙ্কা কমানোর মাধ্যমে লিভার সিরোসিস এবং ক্যান্সারের চিকিৎসা করার সম্ভাবনা রয়েছে।
আলজেইমারের মডেল হিসেবে রাখা ইঁদুর এবং স্বাভাবিক ইঁদুরের উপর অ্যামাইলয়েড বিটা স্বল্পতা পরীক্ষা করার জন্য 3D6 অ্যান্টিবডি ব্যবহার করে অ্যামাইলয়েড বিটা উৎপাদন বন্ধ করে দেওয়া হয়। অ্যামাইলয়েড বিটা স্বল্পতা জনিত সবগুলো মডেলেই লিভার সিরোসিস বা লিভার ক্যান্সারের ইঙ্গিত পাওয়া গেছে।
তাছাড়া ইঁদুরের শরীরে প্রচুর পরিমাণে অ্যামাইলয়েড বিটা উৎপাদন হওয়াতে, সিরোসিস প্ররোচিত করে এমন রাসায়নিক কার্বন টেট্রাক্লোরাইড ব্যবহার করেও ফাইব্রোসিস উৎপাদন করতে অক্ষম ছিলেন গবেষকরা।
যখন আলজেইমার রোগের মডেল হিসাবে ব্যবহৃত ইঁদুর এর মাধ্যমে প্রচুর পরিমাণে অ্যামাইলয়েড বিটার কোষ কালচার করা হয়, তখন এটি ফাইব্রোসিস এবং ক্যান্সারের সাথে সম্পর্কিত নির্দিষ্ট প্রোটিনের মাত্রা কমিয়ে দেয়। উদাহরণস্বরূপ, অ্যামাইলয়েড বিটা এর উপস্থিতিতে ADAM10 এবং ADAM17 এর মাত্রা হ্রাস পায়, যা অ্যামাইলয়েড-বিটার উপস্থিতিতে ফাইব্রোসিস এবং ক্যান্সার চিহ্নিতকারী।
অপর দিকে বিটা-অ্যামাইলয়েড একটি একক অণু হিসাবে জীবন শুরু করলেও প্রাথমিকভাবে ছোট ছোট গুচ্ছে পরিণত হয় যা মস্তিষ্কে অবাধে ভ্রমণ করতে পারে এবং অবশেষে প্লেকে পরিণত হয়, যা আলজেইমারের একটি বৈশিষ্ট্য।
গবেষণায় প্রথমবারের মতো দেখা গেছে যে এই গুচ্ছবদ্ধ আকারের বিটা-অ্যামাইলয়েড স্নায়ু কোষের উপর একটি রিসেপ্টরকে দৃঢ়ভাবে আবদ্ধ করতে পারে এবং একটি আন্তঃকোষীয় প্রক্রিয়া চালু করে যা অন্যান্য স্নায়ু কোষের সাথে তাদের সিন্যাপসও ক্ষয় করতে পারে।
সিন্যাপস স্নায়ু কোষের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করে। এগুলো আমাদের স্মৃতি সংরক্ষণ, চিন্তাভাবনা ও আবেগ প্রক্রিয়াকরণ এবং আমরা কীভাবে পরিবেশে প্রতিক্রিয়া দেখাবো সেই শৃঙ্খলা রক্ষায় ভূমিকা রাখে। বিটা-অ্যামাইলয়েড এই সিন্যাপস ক্ষয় করে স্মৃতি অবক্ষয় এর জন্য দায়ী।
পরীক্ষায় এটাও দেখা গেছে, গবেষণায় ব্যবহৃত ইঁদুর গুলোর শরীরে খুব অল্প বয়সে উচ্চ মাত্রায় বিটা-অ্যামাইলয়েড উপস্থিত থাকলেও তারা বৃদ্ধ না হওয়া পর্যন্ত এটি তাদের উপর কোনো প্রভাব ফেলছে না।
গবেষকদের ধারণা, বিটা-অ্যামাইলইয়েড এর মাত্রা হ্রাস করে এমন অ্যান্টিবডি ব্যবহার করে আলজেইমারের ইমিউনোথেরাপি করা যেতে পারে। অপরদিকে রক্ত প্রবাহে এর পরিমাণ উল্লেখযোগ্যভাবে পরিবর্তন না করে স্থানীয়ভাবে লিভারে অ্যামাইলয়েড বিটা মাত্রা বৃদ্ধি করে এমন পদ্ধতির ব্যবহার করে লিভার ফাইব্রোসিস চিকিৎসা করা সম্ভব হবে।
তাফহীমা ফেরদৌস / নিজস্ব প্রতিবেদক
তথ্যসূত্র: এডভান্স সায়েন্স নিউজ, স্ট্যানফর্ড মেডিসিন, ন্যাশনাল লাইব্রেরী অব মেডিসিন