নাসা “কিউরিওসিটি মার্স রোভার” মঙ্গলগ্রহের মাটিতে এক রোড ট্রিপের ব্যাবস্থা করেছে যা পুরো গ্রীষ্মকাল জুড়ে গ্রহের প্রায় ১ মাইল বা ১.৬ কিলোমিটারের মত নির্দিষ্ট কিছু অঞ্চল পরিভ্রমণ করবে। উক্ত যাত্রা শেষে রোভারটি ২০১৪ সাল থেকে অনুসন্ধান করতে থাকা গ্রহের প্রায় ৩মাইল (৫ কিলোমিটার) বিস্তৃত একটি পর্বতের পরবর্তী অংশে আরোহণ করতে সক্ষম হবে।
আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের প্রায় কাছাকাছি অবস্থিত উক্ত পর্বতের চূড়াটি বিভিন্ন পাললিক শিলার সমন্বয়ে তৈরি যা যুগ যুগ আগেকার ইতিহাস ধারণ করে আসছে। প্রত্যেকটি পাললিক শিলা গবেষণা করলে জানা যাবে পৃথিবীর আদিম পরিবেশের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ অবস্থা হতে কিভাবে গ্রহটি আরো বায়ুহীন, হিমশীতল এক প্রান্তরে পরিণত হয়েছে!

রোভারের পরবর্তী স্টপ হবে মূলত মঙ্গলগ্রহের ওই পর্বতের নির্দিষ্ট একটি অংশে যা “সালফেট বহনকারী ইউনিট” নামে পরিচিত। “সালফেট” সাধারণত জিপসাম এবং ইপসাম লবণের মতোই পানির সংস্পর্শে আসলে বাষ্পে রূপান্তরিত হয় এবং প্রায় ৩ বিলিয়ন বছর আগ থেকে জলবায়ু এবং জীবনের সম্ভাবনাগুলো কীভাবে পরিবর্তিত হয়েছিল তার ব্যাপারে বিস্তর ধারণা দেয়।
উল্লেখ্য, সালফেটের উক্ত অঞ্চলে বালির বিশাল এক খাদ রয়েছে যেখানে স্বভাবতই রোভারটিকে সাবধানে চলাচল করতে হবে। তবে শরৎকালের শুরুর দিকেই রোভার চালনাকারীরা মঙ্গলগ্রহের ঐ অঞ্চলে পৌঁছানোর প্রত্যাশা করছেন; সেলক্ষ্যে বিজ্ঞানীরা দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়ায় নাসার “জেট প্রোপালশন ল্যাবরেটরি”-তে বসে কাজ করবার আদলে ঘরে বসেই কিউরিওসিটিকে নির্দেশনা দিচ্ছেন।
অন্যদিকে জেপিএল (জেট প্রোপালসন ল্যাবরেটরি) লিড রোভার ড্রাইভার ম্যাট গিল্ডনার বলেছেন, “কিউরিওসিটি রোভার মানুষ ব্যতীত রোবটের মত নিজে পুরোপুরিভাবে চলাচলে অক্ষম। তবে পথিমধ্যে যেকোনো বড় পাথর বা ঝুঁকিপূর্ণ কোনো অঞ্চল এড়িয়ে যেতে সহজ সরল সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা এর রয়েছে। সেক্ষেত্রে ঐসকল ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলের ব্যাপারে পূর্ব থেকেই রোভারকে ইনফর্ম করা না হলে এটি মাঝপথেই যেকোনো সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে।”

উল্লেখ্য, রোভারটি যাত্রাপথে পর্বতের “মাটি বহনকারী ইউনিট” অঞ্চল অতিক্রম করার সময় কিছু কাদামাটি সেখানে পর্যবেক্ষণ করে যা সুদূর ১৯৯০ সাল থেকেই বিজ্ঞানীরা অনুসন্ধান চালিয়ে আসছে। যে ধরনের আর্দ্র পরিবেশ এ টাইপের কাদামাটি তৈরি করে থাকে তা অনুসন্ধান করতে বিজ্ঞানীরা অধিক আগ্রহী; তারা ধারণা করছেন হয়তোবা এর মাধ্যমে প্রাচীন জনজীবনের কোনো ইতিহাস প্রকাশ পেতে পারে।
পর্বতটিতে পাললিক শিলার উপর এক প্রকার টুপি সদৃশ ত্রিকোনাকৃতি ঢালু স্থান রয়েছে যা “গ্রিনহিউ পেডিমেন্ট” নামে পরিচিত এবং যা সম্ভবত আগ্নেয়গিরির লাভা হতে রূপান্তরিত। আদিতে গ্রহের পরিবেশ অনেকটাই পৃথিবীর মতো ছিল, কিন্তু ধীরে ধীরে গ্রহ হতে প্রায় ৯৬ মাইল(১৫৪ কিলোমিটার) এর মত দীর্ঘ হ্রদগুলোও অদৃশ্য হয়ে গিয়েছে এবং পাদদেশের যে বেলেপাথরগুলো আজ আমরা দেখছি, তার সবটুকুই হ্রদের রূপান্তরিত অবস্থা। গ্রিনহিউ পেডিমেন্টটি অবশ্য পরে তৈরি হয়েছিল (যদিও বাতাস এবং পানির সংমিশ্রণে কিংবা লাভা হতে এটি তৈরি কিনা তা আজও অজানা); আর বাতাসের মাধ্যমে উড়ে আসা বালি পেডিমেন্টের উপর পড়ে উক্ত টুপি সদৃশ দৃঢ় অবস্থার সৃষ্টি করেছে।
রোভার পরিচালনাকারীরা “গ্রিনহিউ পেডিমেন্ট” অঞ্চলে বিগত মার্চ মাসের মধ্যে আরোহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। কিন্তু পর্বতের উক্ত অঞ্চলটি অতিরিক্ত ঢালু হবার দরুন সেখানে পৌঁছানো কষ্টসাধ্য ছিল বিধায় পরবর্তীতে আরোহণের সিদ্ধান্ত পিছিয়ে দেয়া হয়। পর্বতের শীর্ষাঞ্চলে রোভারটি বেলেপাথরের পৃষ্ঠে ছোট ছোট কিছু নোডিউলস (ফাঁপা গুটিবিশেষ যা পানির উপস্থিতিতে সৃষ্টি হয়) পর্যবেক্ষণ করে। আর উক্ত নোডিউলস গুলোই বিজ্ঞানীদের দারুণ ভাবিয়ে তোলে।

বিখ্যাত ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ডক্টরেট স্টুডেন্ট এবং রোভার পরিচালনাকারী আলেকজান্ডার ব্রিক বলেছেন, “এ জাতীয় নোডিউলস গঠনের জন্য পানির প্রয়োজন। আমরা পর্বতের বেলেপাথরের উপরে এবং নিচেও বেশ কিছু নোডিউলস পর্যবেক্ষণ করেছি এবং এগুলো সৃষ্টি হবার মাধ্যমে পানির অস্তিত্বও যে সেখানে বিদ্যমান তা স্পষ্ট বুঝতে পেরেছিলাম।”
নোডিউলস গুলো পুরো পর্বত জুড়েই বিস্তৃত রয়েছে। বিজ্ঞানীরা আরো ব্যাক্ত করেন, “হ্রদগুলো সৃষ্টি হবার আগ থেকেই সেখানে পানির উপস্থিতি বিদ্যমান ছিল।” বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন পৃথিবীর আদিম অবস্থা হয়তোবা এমনই ছিল। আর পরবর্তীতে এই অবস্থা হতেই জীবের উৎপত্তি সাধিত হয়।
জেপিএল এর উভয় মিশনের দায়িত্বে থাকা ডেপুটি প্রজেক্ট সায়েন্টিস্ট অ্যাবিগেল ফ্রেইমেন বলেছেন, “কিউরিওসিটি মার্স রোভার পানির ইতিহাস অনুসন্ধান করা ছাড়াও জীবের অস্তিত্ব নিরুপণেও তৈরি করা হয়েছে। আমরা এমন একটি প্রাচীন পৃথিবী উন্মোচন করতে যাচ্ছি যা আমাদের উপলব্ধিরও বাইরে।”
হাসান সৈকত/ নিজস্ব প্রতিবেদক
+1
+1
1
+1
+1
2
+1
+1
+1