বজ্রপাতের ইংরেজি প্রতিশব্দ হলো Clap of Thunder এবং বজ্রপাতের আগে আকাশের যে আলোর ঝলকানি বা বিদ্যুৎ চমক দেখা যায় তাকে বলে Bolt of Lightening.
বজ্রপাত হলো আবহাওয়ার এমন একটি অবস্থা যার ফলে কোনো স্থানে একইসাথে তীব্র আলো, উচ্চ শব্দ ও তাপ সৃষ্টি হয়। বজ্রপাতের জন্য দায়ী মূলত তিনটি উপাদান। এগুলো হলো: আর্দ্রতা, বায়ু ও লিফট।
বজ্রপাতের ফলে এতো বেশি পরিমাণে বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয় যে এই বিদ্যুৎ এর পরিমাণ নির্ণয় করা কিছুটা জটিল। তবে লেটারস জার্নালের এক গবেষণায় দেখা যায়, বজ্রপাতের ফলে প্রায় ১.৩ বিলিয়ন বোল্ট বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়। এই গবেষণায় তারা মহাজাগতিক রশ্মি পর্যবেক্ষণ করার জন্য তৈরি একটি দূরবীন ব্যবহার করেন।
পদার্থবিজ্ঞানী মাত্তিও রিনি এর মতে, এর আগে বজ্রপাতের ফলে তৈরি বিদ্যুৎ এর পরিমাপ করার জন্য তারা Storm Cloud এর মাঝে পর্যবেক্ষণকারী বেলুন ও বিমান ছেড়ে দিয়েছিলেন। এই পদ্ধতিতে সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ পরিমাপ করা হয় ১৯৯০ এর দশকে। তখন মেক্সিকোতে হওয়া এক ঝড়ের সময় সৃষ্ট বজ্রপাত থেকে তারা ১৩০ মিলিয়ন ভোল্ট বিদ্যুৎ পরিমাপ করেন।
তবে ভারতের মুম্বাইয়ের টাটা ইনস্টিটিউট অব ফান্ডামেন্টাল রিসার্চের গবেষকরা বেলুনের চেয়ে আরও আধুনিক কিছু ব্যবহার করে বজ্রপাত পর্যবেক্ষণ করার সিদ্ধান্ত নেন। এমন একটি যন্ত্র হলো মিউন ডিটেক্টর। মিউন হলো পৃথিবীর বায়ুমন্ডলের উপরের স্তরে উৎপন্ন কিছু চার্জিত কণা। মহাজাগতিক রশ্মি ও বিভিন্ন কণার সংঘর্ষের ফলে এইসব চার্জিত কণা উৎপন্ন হয়। এর অর্থ হলো সমগ্র পৃথিবী জুড়ে প্রতিনিয়ত এইসব চার্জিত মিউন কণার বৃষ্টি হচ্ছে। তবে কোনো কিছু যদি এইসব মিউন কণার পথে আসে তবে এরা শক্তি হারায়। কিছু বিশেষ যন্ত্র ব্যবহার করে মিউন কণার শক্তি ক্ষয়ের পরিমাণ নির্ণয় করা যায়।
টাটা ইনস্টিটিউটের GRAPES-3 টেলিস্কোপটি প্রতি মিনিটে দশ মিলিয়নেরও বেশি মিউন কণা সনাক্ত করতে পারে। তবে গিজমোডো এর জর্জ ডিভর্স্কি এর মতে, তারা মিউন ডিটেক্টরটিতে ইলেকট্রিক ফিল্ড মনিটর সংযোজন করেছেন এবং এর সাহায্যে তারা সব ধরনের ঝড় পর্যবেক্ষণ করেছেন। ঝড়ের পাশাপাশি মেঘে উপস্থিত মিউন কণার শক্তি ক্ষয় এর পরিমাণ পর্যবেক্ষণ করে তারা ঝড়ের সময় কতটুকু বিদ্যুৎ উৎপাদন হতে পারে তা নির্ণয় করেছেন।
২০১১ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত এই দলটি প্রায় ১৮৪ টি ঝড়ের ডেটা সংরক্ষণ করেছেন। তারপর তারা এই তালিকা থেকে সবচেয়ে বড় সাতটি ঝড়ের ডেটা আলাদা করেন, এর মধ্যে ৬টি ঝড়ের তীব্রতা বেশি হওয়ায় বিদ্যুৎ এর পরিমাণ পরিমাপ করতে ব্যাপক সমস্যা হয়। তবে ২০১৪ সালের ১ ডিসেম্বর যে ঝড়টি হয় সেটা থেকে তারা বেশ কিছু ডেটা সংগ্রহ করেন। সেই ঝড়টি প্রায় ১৪৬ বর্গামাইল জায়গা জুড়ে পৃথিবীর উপরিভাগ থেকে সাত মাইল উচ্চতায় প্রতি ঘন্টায় ৪০ মাইল বেগে অতিক্রম করে। এই ঝড়ের সময় মিউন কণার সংখ্যা ক্ষয় এর উপর ভিত্তি করে বজ্রপাতের সর্বোচ্চ শক্তি গণনা করা হয় ১.৩ বিলিয়ন ভোল্ট। এটি আগে গণনা করা বিদ্যুৎ এর পরিমাণের প্রায় ১০ গুণ ছিলো।
আরো পড়তে পারেনঃ রহস্যে ঘেরা ৫ ভয়ংকর শক্তিশালী বজ্রপাত
টাটা ইনস্টিটিউটের এই গবেষণার সহলেখক সুনীল গুপ্ত লাইভসায়েন্সে বলেন, বিজ্ঞানীরা অনুমান করেছেন যে ১৯৮০ এর দশকে বজ্রমেঘ গুলোতে প্রায় গিগাভোল্ট পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপন্ন হতো। তবে এটি এখনো প্রমাণিত হয়নি। এতে যে পরিমাণ বিদ্যুৎশক্তি উৎপন্ন হতো তা দিয়ে নিউইয়র্ক শহরে ২৬ মিনিট বিদ্যুৎ সরবরাহ করা যেতো। তবে সুনীল গুপ্ত এর মতে বজ্রপাত থেকে বিদ্যুৎ উৎপন্ন করা বেশ কঠিন কাজ, কারণ বজ্রপাত এতো বেশি শক্তিশালী যে যেকোনো কিছুকে গলিয়ে দিতে পারে।
লুইসিয়ানা স্টেট ইউনিভার্সিটির মহাজাগতিক ও গামা-রে গবেষক মাইকেল চেরি এর মতে, মিউন ডিটেক্টিং এর কৌশলটি বেশ ভালো তবে এই পদ্ধতি কেবল বিশেষ কিছু মেঘের শক্তি পরিমাপ করা যায়। ভবিষ্যৎ এ যদি মিউন ডিটেক্টর এর সাথে ড্রোন বা পর্যবেক্ষণকারী বেলুন পাঠানো হয় তবে আরো বেশি কিছু জানা যাবে।
তবে গিগাভোল্ট রেঞ্জ এ ঝড় হতে পারে এই তথ্য থেকে একটি রহস্য সমাধান হয়। ১৯৯০ এর দশকে স্যাটেলাইট এর সাহায্যে বায়ুমণ্ডলের উচ্চস্তর থেকে গামা-রে ফ্ল্যাশ সনাক্ত করা হয়, এদেরকে বলে “Terrestrial Gamma Ray Flashes“। যদি কোনো ঝড়ের ফলে গিগাভোল্ট পরিসরে বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয় তবে এ থেকে বুঝা যায়, তারা এতো শক্তি উৎপন্ন করে যার ফলে ইলেকট্রন ভেঙে গামা-রে ফ্ল্যাশ তৈরি করে ফেলে। যদিও গিগাভোল্ট পরিমাণ শক্তি উৎপন্ন হওয়ার বিষয়টি এখনো প্রমাণিত নয়।
নিশাত তাসনিম/ নিজস্ব প্রতিবেদক