রক্তশূন্যতা বিভিন্ন ধরনের হতে পারে। তাদের মধ্যে সিকেল সেল রোগ (Sickle Cell Disease) বা SCD অন্যতম। এই রোগে জিনগত কারণে মানবদেহের রক্তকণিকা কাস্তের আকার ধারণ করে ফলে তারা দ্রুত ভেঙ্গে যায় আর মানুষ রক্তশূন্যতার কবলে পড়ে। সম্প্রতি সিকেল সেল রোগের প্রতিকারে শুরু হলো জিন এডিটিং এর ব্যবহার।
রক্তশূন্যতা বা অ্যানিমিয়া এদেশের নারীদের কাছে খুবই পরিচিত একটি নাম। কিন্তু শুধু নারীরা নয় পুরুষেরাও অ্যানিমিয়ার শিকার হয়ে থাকেন। তবে এদেশে নারী রোগীদের সংখ্যাটাই যেন বেশি। মানবদেহের রক্তে যখন লোহিত রক্তকণিকা বা হিমোগ্লোবিন কমে যায় তখন সেই অবস্থাকে অ্যানিমিয়া বা রক্তশূন্যতা বা রক্তস্বল্পতা বলে। শরীরে আয়রনের অভাব হলে রক্তে অপর্যাপ্ত পরিমাণ আয়রনের কারণে দুর্বল লাগে, বমি-বমি ভাব আসে, সারাদিন ঘুমঘুম ভাব থাকে আর চেহারা ফ্যাকাশে হয়ে যায় ।
ব্যাক্টেরিয়া যেভাবে ভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিকার করে সেটা নিয়ে গবেষণা করতে গিয়েই একদল বিজ্ঞানী CRISPR এর সন্ধান পান। বিজ্ঞানীরা দেখেন বেশিরভাগ ব্যাক্টেরিয়ার একধরনের অভিযোজনযোগ্য রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থা (Adaptive immune system) আছে। যার মাধ্যমে ব্যাক্টেরিয়া ভাইরাসের ডিএনএ শনাক্ত করে ধ্বংস করতে পারে। এই সিস্টেমের নামই হলো CRISPR (ক্রিসপার)।
CRISPR সিস্টেমের একটি অংশ হলো প্রোটিন Cas9 । এই প্রোটিন ভাইরাসের ডিএনএ শনাক্ত এবং তা ব্যবচ্ছেদ করতে পারে। বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে পান যে Cas9 প্রোটিনের এই বৈশিষ্ট্য জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং প্রযুক্তিতে ব্যবহার করা সম্ভব। যার মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা কোষের ডিএনএর কিছু অংশ সরিয়ে ফেলতে বা কিছু কৃত্রিম বাড়তি অংশ যোগ করতে পারেন।
মার্কিন FDA (Food and Drug Administration) গত ৮ই ডিসেম্বর সিকেল সেল রোগের জন্য CRISPR/Cas9 ব্যবহৃত একটি চিকিৎসা পদ্ধতির অনুমোদন করেন। চিকিৎসাটির নাম Casgevy। এটি CRISPR/Cas9 ব্যবহার করে জিনগতভাবে কোষকে পরিবর্তন করা বিশ্বের প্রথম চিকিৎসা পদ্ধতি।
সিকেল সেল রোগ হিমোগ্লোবিনের একটি জেনেটিক ত্রুটির কারণে ঘটে। সাধারণ রক্তকণিকাগুলো রক্তনালিগুলোর মধ্য দিয়ে পিছলে যাওয়ার মতো যথেষ্ট বাঁকানো হলেও অসুস্থ রক্তকণিকাগুলো নমনীয় এবং তাদের আকৃতির কারণে রক্তনালিগুলোর মধ্য দিয়ে আটকে যায় ফলে রক্ত প্রবাহ সীমাবদ্ধ হয় এবং ব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। যে ব্যক্তিরা এই রোগের গুরুতর অবস্থায় ভুগছেন তাদের বছরে একাধিকবার হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়।
সিকেল সেল রোগের জন্য কিছু চিকিৎসা আগে থেকেই রয়েছে যার মধ্যে হাইড্রোক্সিউরিয়া (Hydroxyurea) এর মতো ওষুধ গ্রহণ বা অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপনের মতো চিকিৎসা অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। কিন্তু হাইড্রোক্সিউরিয়া সবার জন্য কাজ করে না এবং অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপনের জন্য একজন জিনগতভাবে মিলিত দাতা প্রয়োজন যা সাধারণত একজন ভাইবোন।
Casgevy একটি অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপনের মতোই কাজ করে কিন্তু এখানে রোগীরা নিজস্ব কোষের উপর নির্ভর করে অন্যের অস্থিমজ্জার উপর নির্ভর না করে। CRRISP ব্যবহার করে এই চিকিৎসাতে অস্থিমজ্জা কোষের জেনেটিক নীলনকশাকে পরিবর্তন করে যা রক্তকোষের জন্ম দেয়। সম্পাদিত কোষগুলো ভ্রূণের হিমোগ্লোবিন তৈরি করে যা সাধারণত ভ্রূণ এবং অল্প বয়স্ক শিশুদের দ্বারা তৈরি হয় যা লাল রক্তকণিকাগুলোকে সিকেল সেল রোগে তৈরি করে না ।
এই পদ্ধতিতে যে কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই এমন নয়। কিন্তু সিকেল সেল রোগের অভিশাপ থেকে বাঁচার ইচ্ছা এসব পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়াকে তাদের কাছে তুচ্ছ করে তোলে। আরেকটি সমস্যা হচ্ছে এই চিকিৎসাতে একজন রোগীকে ২ কোটি টাকা ব্যয় করতে হতে পারে।
১৬ই নভেম্বরে যুক্তরাজ্যের কর্মকর্তারা সিকেল সেল রোগীদের পাশাপাশি বিটা-থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে Casgevy ব্যবহারে প্রথম সম্মতি দেন। এটি একটি রক্তের ব্যাধি যেখানে শরীর যথেষ্ট হিমোগ্লোবিন তৈরি করে না। ৩০শে মার্চের মধ্যে FDA সিদ্ধান্ত নেবে যে বিটা-থ্যালাসেমিয়ার চিকিৎসার জন্য এই থেরাপিও ব্যবহার করা যেতে পারে কিনা।
হাসিবুল ইসলাম সৌরভ/ নিজস্ব প্রতিবেদক
তথ্যসূত্র: সায়েন্স নিউজ