লোহা কেবল একটি ধাতু নয়; এটি এমন এক ভিত্তিপ্রস্তর যার উপর সভ্যতা নির্মিত হয়েছে এবং সাম্রাজ্য গড়ে উঠেছে। যোদ্ধাদের প্রাচীন অস্ত্র থেকে শুরু করে আধুনিক অবকাঠামো তৈরি, মানব ইতিহাস গঠনে লোহার ভূমিকার গল্পগুলোকে মোটেও অতিরঞ্জিত বলা যায় না। তবে লোহার বিবর্তনের গল্পগুলো কেবল ধাতুবিদ্যার মধ্যে সীমিত নয়। এতে আছে শিল্প বিপ্লব, ভূ-রাজনীতি এবং মানুষের উচ্চাকাঙ্ক্ষার গল্পগুলোও।
তারকা (যেমন আমাদের সূর্য) জ্বলজ্বল করে কারণ তারা হলো বিশাল গরম গ্যাসের গোলক যেখানে nuclear fusion বিক্রিয়া ঘটে। নিউক্লিয়ার ফিউশনে ছোট ছোট পারমাণবিক নিউক্লিয়াস (যেমন হাইড্রোজেন) একত্রিত হয়ে বড় নিউক্লিয়াস (যেমন হিলিয়াম) তৈরি করে। এতে প্রচুর পরিমাণে শক্তি মুক্ত হয়। এই শক্তিই তারাকে আলো ও তাপ উৎপন্ন করতে সাহায্য করে।
যতই একটি তারা বয়সে বড় হয়, এটি হালকা মৌলগুলোর সংযোজনের মাধ্যমে ক্রমাগত ভারী মৌল তৈরি করতে থাকে। যেমন: হাইড্রোজেন সংযোজিত হয়ে হিলিয়াম তৈরি করে।
হিলিয়াম সংযোজিত হয়ে কার্বন ও অক্সিজেন তৈরি করে। এই প্রক্রিয়া চলতে থাকে, যার ফলে সিলিকন এবং শেষ পর্যন্ত লোহা তৈরি হয়।
কিন্তু এখানে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো লোহা পর্যন্ত এসে প্রক্রিয়াটি থেমে যায়। কিন্তু কেন?
একটি পরমাণুর নিউক্লিয়াস প্রোটন ও নিউট্রন দ্বারা গঠিত, যা একটি strong nuclear force দ্বারা একত্রে আবদ্ধ থাকে। কতটা শক্তভাবে এগুলো আবদ্ধ আছে তা নির্ধারণ করে সংযোজন বা ফিউশন থেকে কতটুকু শক্তি পাওয়া যাবে তার উপর।
হালকা মৌলগুলোর (যেমন হাইড্রোজেন, হিলিয়াম) সংযোজনে শক্তি উৎপন্ন হয়, কারণ নতুন নিউক্লিয়াস আরও স্থিতিশীল হয় এবং কিছু ভর শক্তিতে পরিণত হয়।
কিন্তু লোহা পর্যন্ত আসার পর সমস্যা দেখা দেয়। লোহার নিউক্লিয়াস এতটাই শক্তভাবে আবদ্ধ থাকে যে এটি অন্য কিছুর সঙ্গে সংযোজিত হলে পূর্বের তুলনায় অস্থিতিশীল হয়। ফলে শক্তি উৎপন্ন হওয়ার পরিবর্তে শক্তি শোষণ করা শুরু করে।
কাঠ আগুনে পোড়াবার পর শুধু ছাই অবশিষ্ট থাকে। একইভাবে যেহেতু নিউক্লিয়ার ফিউশনের পুরো প্রক্রিয়া শেষে শুধুমাত্র লোহা-ই বিদ্যমান থাকে, তাই লোহাকে নিউক্লিয়ার ছাই হিসেবে অভিহিত করা হয়।
এশিয়া মাইনর অর্থাৎ বর্তমান তুরস্কের প্রাচীন হিট্টিটরায় সম্ভবত প্রথম লোহাকে তার আকরিক থেকে গলিয়ে বের করার (smelting) পদ্ধতি আবিষ্কার করা হয়েছিল। আনুমানিক ১৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে, এই নতুন ধাতু তাদের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক শক্তি এনে দেয়, তাই তারা লোহা আহরণের প্রক্রিয়াটি কঠোরভাবে গোপন রেখেছিল। তবে এটি তাদের রক্ষা করতে পারেনি।
আনুমানিক ১২০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে, সি পিপলস (Sea People) নামে পরিচিত একদল যোদ্ধার আক্রমণে তাদের সভ্যতা ধ্বংস হয়ে যায়। এরপর লোহার কাজে পারদর্শী কারিগররা বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়েন এবং তাঁদের সঙ্গে এই প্রযুক্তিও ছড়িয়ে যায়। এভাবেই লৌহ যুগের (Iron Age) সূচনা ঘটে।
তাদের কিছু লোহার কারিগর পশ্চিম ইরানে গিয়ে পৌঁছান। সেখানে তারা আরও উন্নত এক ধরনের লোহা, ইস্পাত (steel) আবিষ্কার করেন। ইস্পাত মূলত লোহা এবং কার্বনের (সাধারণত ২% এর নিচে) একটি মিশ্রণ। ইস্পাত লোহার পূর্ণ সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর একটি চাবিকাঠি হিসেবে আবির্ভূত হয়। ঢালাই লোহা (cast iron) ভঙ্গুর হলেও, ইস্পাত তার অভ্যন্তরে একটি শক্তিশালী জালক কাঠামো (lattice structure) গঠন করে, যা প্রচণ্ড চাপ সহ্য করতে পারে ভাঙা ছাড়াই। ফলে অস্ত্র থেকে অবকাঠামো পর্যন্ত সবকিছুতেই ইস্পাত ব্যবহার করা সম্ভব হয়।
পঞ্চদশ শতাব্দী নাগাদ জাপানের সামুরাইরা বিশ্বের সবচেয়ে উঁচুমানের তলোয়ারের ইস্পাত তৈরির সক্ষমতা অর্জন করেছিল। এই সামুরাই তলোয়ারগুলি “tamahagane” নামক বিশেষ ইস্পাত থেকে তৈরি করা হতো।
এটি এমন একটি বিশেষ ধরনের ইস্পাত যা প্রশান্ত মহাসাগরের আগ্নেয়গিরির কালো বালি থেকে উদ্ভূত ম্যাগনেটাইট নামক লোহার খনিজ দিয়ে তৈরি হতো ( যা মূলত কম্পাস সূঁচ তৈরিতে ব্যবহৃত হয়)। এই ইস্পাত প্রস্তুত করতে চার ফুট উঁচু, চার ফুট চওড়া এবং বারো ফুট লম্বা একটি বিশাল মাটির পাত্র ব্যবহার করা হতো, যা টাটারা নামে পরিচিত।
সামুরাইরা উচ্চ-কার্বন সমৃদ্ধ ইস্পাত, যা শক্ত কিন্তু ভঙ্গুর এবং নিম্ন-কার্বন ইস্পাত , যা দৃঢ় কিন্তু তুলনামূলকভাবে নরম এ দুটির মধ্যে পার্থক্য করতে জানতো।
উচ্চ-কার্বন সমৃদ্ধ ইস্পাতে কার্বন পরমাণুগুলি লোহার ক্রিস্টাল ল্যাটিসের সাথে একত্রিত হয়ে আইরন কার্বাইড (Fe₃C) তৈরি করে। এতে কাঠামোর কঠোরতা এবং ভঙ্গুরতা বৃদ্ধি পায় ফলে ক্রিস্টাল কম নমনীয় হয়। তাই দেখা যায় এটি বিকৃতি প্রতিরোধী হলেও উচ্চ চাপে ভেঙে যায়।
অপরদিকে যখন ইস্পাতে কম কার্বন থাকে তখন লোহার ক্রিস্টাল ল্যাটিস সম্পূর্ণরূপে পরিবর্তন করার মত পর্যাপ্ত কার্বন থাকে না। তাই এটি বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ফেরাইট হিসাবে থাকে। ফেরাইট লোহার একটি নরম এবং বাঁকানো রূপ।
তারা নিশ্চিত করতো যে নিম্ন-কার্বন ইস্পাতটি যাতে তলোয়ারের কেন্দ্র তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। এটি তলোয়ারকে দৃঢ় এবং নমনীয় করে তোলে। যা যুদ্ধের সময় ব্লেডগুলি ভাঙার সম্ভাবনা কমিয়ে দেয়। উচ্চ-কার্বন ইস্পাত ব্যবহৃত হতো তলোয়ারের প্রান্ত তৈরিতে। উচ্চ-কার্বন ইস্পাত বেশ টেকসই হওয়ায় সেটিকে চাইলেই খুব ধারালো করা যেত।
১৮৫৬ সালে, স্যার হেনরি বেসেমার (Sir Henry Bessemer) তাঁর উদ্ভাবিত বেসেমার কনভার্টার (Bessemer converter) দিয়ে ইস্পাত উৎপাদনে বিপ্লব ঘটান। এই প্রক্রিয়ায়, গলিত পিগ আয়রনের (pig iron) মধ্যে বাতাস প্রবাহিত করে অতিরিক্ত কার্বন জ্বালিয়ে ফেলা হয়, যা একে ইস্পাতে রূপান্তরিত করে। তার এই উদ্ভাবন ঐ সময় চলমান শিল্প বিপ্লবকে (industrial revolution) আরও বেশি ত্বরান্বিত করে।
বেসেমার কনভার্টারের কার্যপদ্ধতি কী?
১. গলিত পিগ আয়রন দিয়ে শুরু: প্রথমে তরল উচ্চকার্বনসমৃদ্ধ লোহা (pig iron) কনভার্টারের ভেতরে ঢালা হয়।
২. এর মধ্যে বাতাস প্রবাহিত করা: বেসেমারের মূল ধারণা ছিল তলদেশ থেকে পাইপের মাধ্যমে বাতাস প্রবাহিত করা। বাতাসের বুদবুদগুলো তরল ধাতুর ভেতর দিয়ে ওপরে উঠতে থাকে।
৩. কার্বন দূর করা: বাতাসের অক্সিজেন পিগ আয়রনের অতিরিক্ত কার্বনের সঙ্গে জারণ বিক্রিয়া করে (oxidation) কার্বন ডাই-অক্সাইড (CO₂) গ্যাসে পরিণত হয়। কার্বন ডাই-অক্সাইড সিলিকন ও ম্যাঙ্গানিজের মতো অন্যান্য ভেজাল সহ পুড়ে বের হয়ে যায়। ফলে তৈরি হয় কম কার্বনযুক্ত ইস্পাত।
৪. দ্রুত ও শক্তিশালী পরিবর্তন: পুরো প্রক্রিয়াটি মাত্র ১০–২০ মিনিটের মধ্যে সম্পন্ন হয়। এসময় কার্বন পুড়ে আগুনের ফুলকি ও স্ফুলিঙ্গ ছিটকে বের হতে থাকে।
যুগান্তকারী এ আবিষ্কারের ফলে শীঘ্রই ইস্পাতের ব্যবহার বিস্তৃত হয়ে পৌঁছে যায় রেলপথ থেকে আকাশচুম্বী ভবন পর্যন্ত। এটি শুধু শক্তিশালী একটি পদার্থ-ই ছিল না; এটি ছিল উন্নয়নের অনুঘটক।
তবে মজার ব্যাপার হলো, ঐ সময়কালে তৈরি হওয়া আইফেল টাওয়ার কিন্তু ইস্পাত দ্বারা নির্মিত হয়নি। এর কারণ ছিল ডিজাইনার গুস্তাভ আইফেল তখনো ইস্পাতের নির্ভরযোগ্যতা নিয়ে পুরোপুরি নিশ্চিত ছিলেন না। যদিও পরে এটি তার ভুল হিসেবে প্রমাণিত হয়। কারণ যদি তখন আইফেল টাওয়ারে ইস্পাত ব্যবহার করা হতো, তাহলে এটি আরও উঁচু ও মজবুত হতে পারতো।
বর্তমান সময়ে এসেও ইস্পাতের গুরুত্ব সামান্য পরিমাণও কমেনি।
২০১৮ সালে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের একটি বিখ্যাত টুইট ছিল,
“IF YOU DON’T HAVE STEEL, YOU DON’T HAVE A COUNTRY!”
ট্রাম্পের পাগলাটে স্বভাবের কারণে অনেকে হয়ত এই টুইটকে হেসে উড়িয়ে দিতে চাইবেন। কিন্তু নিকট ইতিহাস ঘাটলেই দেখা যায় ট্রাম্প বাদেও এরূপ ধারণা পোষণকারী আরও ব্যক্তিত্ব ছিল।
১৯৫০-এর দশকের শেষের দিকে মাও সে তুং চীনের শিল্প শক্তি বৃদ্ধির লক্ষ্যে Great Leap Forward নামক একটি ক্যাম্পেইন চালু করেন। ক্যাম্পেইনটির অংশ হিসেবে তিনি দ্রুত ইস্পাত উৎপাদনের দিকে জোর দিয়েছিলেন। এমনকি ঘরে ঘরে ‘চুল্লি’ তৈরির জন্য দেশব্যাপী প্রচারণাও চালানো হয়। এসব চুল্লিতে নাগরিকদের অপ্রয়োজনীয় ধাতব পাত্র এবং সরঞ্জাম গলিয়ে ইস্পাতে রূপান্তরিত করতে উৎসাহিত করা হতো।
পিছিয়ে ছিল না সোভিয়েত রুশও। ইতিহাস জুড়ে, ইস্পাতকে কেবল একটি অর্থনৈতিক সম্পদ হিসেবেই নয়, জাতীয় গর্ব এবং নিরাপত্তার বিষয় হিসেবেও দেখা হয়েছে। ১৯৩০-এর দশকে জোসেফ স্ট্যালিনের অধীনে রাশিয়ায় ম্যাগনিটোগর্স্ক ইস্পাত কারখানা তৈরি করা তার একটি উজ্জ্বল উদাহরণ। জনশূন্য তৃণভূমিতে অবস্থিত এই কারখানাটি লৌহ আকরিকের বিশাল ভাণ্ডার আহরণের জন্য নির্মিত হয়েছিল। স্ট্যালিনের দৃষ্টিভঙ্গি স্পষ্ট ছিল, সোভিয়েত ইউনিয়নের কেন্দ্রস্থলে একটি ইস্পাত কারখানা থাকাটা সোভিয়েত শক্তির প্রতীক এবং জাতির প্রতিরক্ষার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ হিসেবে বিবেচিত হবে।
তবে প্রতিটা ধাতুর মত পৃথিবীতে লোহার ভান্ডারও কিন্তু অফুরন্ত নয়। তাই আজীবন আমরা আকরিক থেকে লোহা আহরণের পদ্ধতিটাকে চলমান রাখতে পারবো না।
এর সমাধান কী?
একটি বিশ্ব কল্পনা করুন, যেখানে স্টিল প্রায় সম্পূর্ণভাবে পুনর্ব্যবহারযোগ্য উপকরণ (recycled materials) থেকে সংগৃহীত হয়। এই ভবিষ্যতের দুনিয়ায় পুরোনো ভবন ও অবকাঠামোগুলো প্রতি কয়েক দশক পর পর ভেঙে ফেলে সেই স্টিল পুনরায় গলিয়ে নতুনভাবে ব্যবহার করা হবে। এই ‘Scrap Steel Age’ কোনো কল্পনাপ্রসূত ধারণা নয়— বরংএটি ধীরে ধীরে বাস্তবে পরিণত হচ্ছে। ধারণা করা হচ্ছে যে, এই শতকের মধ্যেই পুনর্ব্যবহারযোগ্য স্টিলের উৎপাদন লৌহ আকরিক থেকে উৎপাদনের তুলনায় বেশি হবে।
আতিক হাসান রাহাত / নিজস্ব প্রতিবেদক
তথ্যসূত্র: ম্যাটেরিয়াল ওয়ার্ল্ড: দ্য সিক্স র ম্যাটেরিয়ালস দ্যাট শেইপ মডার্ণ সিভিলাইজেশন, ন্যাচার’স বিল্ডিং ব্লকস