পাঁচ বছর বয়সী শিশু গর্ভধারণ করে সন্তান জন্ম দিবে, কখনো ভেবেছেন এমনটা সম্ভব? লিনা মেডিনা, ইতিহাসের সর্বকনিষ্ঠ মা যিনি ৫ বছর ৭ মাস বয়সে সন্তান জন্ম দেন। ১৯৩৩ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর পেরুর এক গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন লিনা। ৫ বছর বয়সে লিনার পেটের আকার বৃদ্ধি ও দেহে পরিবর্তন দেখা দিলে তার বাবা-মা ধারণা করেন পেটে টিউমার হয়েছে। কিন্তু হাসপাতালের ডাক্তাররা পরীক্ষা করে জানায় যে, লিনা মেডিনার পেটে বেড়ে উঠছে আরও একটি প্রাণ, সাত মাসের গর্ভবতী সে।
১৯৩৯ সালের ১৪ই মে লিনা মেডিনা সুস্থভাবে পুত্রসন্তান জন্ম দেন। প্রাকৃতিকভাবে সন্তান জন্মদানের জন্য উপযুক্ত আকৃতির পেলভিস লিনার হয়নি তখনো, পেলভিস ছোট হওয়ায় সিজারিয়ান সেকশনের মাধ্যমে সন্তান জন্ম হয় লিনার। জন্মের পর শিশুর ওজন ছিলো প্রায় ২.৭ কেজি। শিশুটির নাম রাখা হয় গেরার্ডো।

দশ বছর বয়স পর্যন্ত শিশুটি মেডিনাকে বোন হিসেবে চিনতো। সুস্থভাবে বেড়ে উঠলেও ১৯৭৯ সালে মাত্র ৪০ বছর বয়সে অস্থিমজ্জা সংক্রান্ত রোগে মারা যায় গেরার্ডো। লিনার বয়ঃসন্ধিকাল নিয়ে এক প্রতিবেদনে লিখা হয়েছে ৩ বছর বয়স থেকে তার ঋতুস্রাব শুরু হয়, আরেক প্রতিবেদন মতে আড়াই বছর বয়স থেকে তার ঋতুস্রাব শুরু হয়। চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় একে বলে, Precocious Puberty।
সাধারণত মেয়েদের ক্ষেত্রে বয়ঃসন্ধি শুরু হয় ৮ বছর বয়সে এবং ছেলেদের ৯ বছর বয়সে। সময়ের আগেই বয়ঃসন্ধির লক্ষণ প্রকাশ ও প্রজননক্ষম হওয়াকে বলে প্রিকসিয়াস পিউবার্টি। প্রিকসিয়াস পিউবার্টির সম্ভাব্য কারণ হতে পারে ইনফেকশন, হরমোনাল ডিজঅর্ডার, টিউমার, মস্তিষ্কের অস্বাভাবিকতা। লিনা মেডিনা তার পরবর্তী জীবনে সন্তানের বাবা কে ছিলো তা কখনো প্রকাশ করেন নি।
![Lina Medina ~ 5 Year OLD Youngest Mother Ever To Give Birth [ Photos | Videos | Biography ]](https://i.ytimg.com/vi/Sb0S7Q7hG6c/maxresdefault.jpg)
বিষয়টি অনেকটা রহস্যই রয়ে গেছে। যেই ক্লিনিকে লিনা সন্তান জন্ম দিয়েছেন সেখানেই তিনি সেক্রেটারি হিসেবে কাজ করেন এবং লিনা ও তার সন্তানের লেখাপড়ার ব্যবস্থা তারাই করে দেয়। ১৯৭০ সালে লিনা বিবাহ করেন, তার স্বামীর নাম রাওল জোরাডো। ৩৯ বছর বয়সে লিনা তার দ্বিতীয় সন্তানের জন্ম দেন। অনেকেই লিনা মেডিনার ঘটনাকে গুজব বললেও ডাক্তারদের করা এক্স-রে আর বায়োপ্সি এই ঘটনার প্রমাণ।

লিনা মেডিনার ৫ বছর বয়সে জন্ম দেওয়া সন্তানের বাবা কে তা নিয়ে যেহেতু জানা যায়নি তাই এই বিষয়ে আমরা কিছু অনুমানভিত্তিক ব্যাখ্যা দিতে পারি :
১. অনাকাঙ্ক্ষিত যৌনতা বা যৌন হয়রানি : লিনা মেডিনার ঘটনা সংবাদপত্রে বের হওয়ার পর তাকে নিয়ে হৈচৈ পড়ে যায়। তার বাবাকে শিশু যৌন নিপীড়নের অভিযোগে আটক করা হয় তবে পর্যাপ্ত প্রমাণের অভাবে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়। সন্দেহের তালিকায় দ্বিতীয় ছিলো লিনার কাজিন, তার মানসিক সমস্যা থাকায় সন্দেহ করা হয় সে সম্ভবত এই ভয়ঙ্কর কান্ডের সাথে জড়িত। এবারও কোন প্রমাণ মিলেনা। কোন প্রমাণ না মিলায় ধরে নেওয়া হয়, লিনা কোনভাবে অনাকাঙ্ক্ষিত যৌনতার শিকার।
২. ফিটাস ইন ফিটু : সহজভাবে বলতে গেলে, লিনার গর্ভ থেকে জন্ম নেওয়া সন্তানটি হতে পারে লিনার যমজ ভাই। ফিটাস ইন ফিটু এক ধরনের বিরল জন্মগত ত্রুটি যার ফলে পরাশ্রয়ী যমজ শিশু দেহে বেড়ে উঠে। প্রাপ্তবয়স্ক থেকে শুরু করে কয়েক মাস বয়সের শিশুর দেহেও তার যমজ ভাই/বোনকে পাওয়া গিয়েছে। মাতৃগর্ভে যমজ শিশুদের ভ্রুণ বৃদ্ধির সময় একটি ভ্রুণ যখন অন্য ভ্রুণের তুলনায় অধিক খাদ্য-পুষ্টি গ্রহণ করে পরিপূর্ণ বিকাশ লাভ করে তখন এমন ঘটনা ঘটতে পারে। এমন অবস্থায় অপরিপক্ক ভ্রুণ বা পরাশ্রয়ী যমজ কোনভাবে পরিপূর্ণ শিশুর দেহে ঢুকে যায় এবং ভ্রুণটি আর বিকশিত হতে পারে না।
পরাশ্রয়ী যমজ বা Parasitic Twin তার যমজ ভাই বা বোনের দেহকে আশ্রয় করে বেড়ে উঠে। ঠিক শুনেছেন, এই পদ্ধতিতে বাচ্চা নারীদেহ থেকে হতে পারে আবার পুরুষদেহ থেকেও হতে পারে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পেট ফুলে উঠার পর মানুষ ভাবে টিউমার হয়েছে, আল্ট্রাসনোগ্রাফি করলে সত্যতা জানা যায়। এক্ষেত্রে জন্ম নেওয়া বেশিরভাগ শিশুই বিকলাঙ্গ হয় বা কোন না কোন ত্রুটি নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। সুস্থভাবে শিশু জন্মগ্রহণ করলেও সেটি জন্মদাতার ভাই বা বোন।
এখনো পর্যন্ত ফিটাস ইন ফিটু এর প্রায় ২০০টি কেস রেকর্ড করা হয়েছে। এই বিরল ঘটনা প্রতি ৫ লক্ষ জনে ১ জনের হতে পারে। উল্লেখ্য, ফিটাস ইন ফিটুর কেস রেকর্ড বাংলাদেশেও আছে। বাংলাদেশের বগুড়ার আবুল মালেক নামক এক কৃষক ফিটাস ইন ফিটুর উদাহরণ। ২০১১ সালে ৪০ বছর বয়সে পেটের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি দেখা দিলে তিনিও সবার মতো ভাবেন টিউমার হয়েছে, পরবর্তীতে ডাক্তাররা জানান তিনি গর্ভধারণ করেছেন এবং সন্তানটি তার যমজ ভাই।
মূল বিষয় দিয়ে ইতি টানা যাক, লিনা মেডিনার ৫ বছর বয়সে জন্ম দেওয়া সন্তানের রহস্য এখনো জানা যায়নি। লিনা মেডিনা বর্তমানে ৮৭ বছর বয়সি বৃদ্ধা, আজও পর্যন্ত তার সন্তানের রহস্য কোন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ করেননি তিনি।
নিশাত তাসনিম/নিজস্ব প্রতিবেদক
রেফারেন্সঃ
১. https://historyofyesterday.com/the-worlds-youngest-mother-who-gave-birth-at-the-age-of-5-fea0678c3e9d
২. https://www.thesun.co.uk/fabulous/2815926/five-year-old-mother-lina-medina/
৩. https://en.m.wikipedia.org/wiki/Lina_Medina
৪. https://www.mayoclinic.org/diseases-conditions/precocious-puberty/symptoms-causes/syc-20351811
৫. https://www.sciencedirect.com/science/article/pii/S2213576615300208
৬. https://www.thedailystar.net/news-detail-186543














