বিজ্ঞানের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো চিকিৎসা বিজ্ঞান। পদার্থ, রসায়ন এর বিভিন্ন জটিল শাখার উন্নতির পাশাপাশি বিজ্ঞানের উন্নতিও মানব জাতির জন্য অত্যাবশ্যক। আর সেই চিকিৎসা বিজ্ঞানে সম্প্রতি নতুন এক মাত্রা যোগ হলো। আর তা হলো মানব কোষ ব্যবহার করে তৈরি করা অ্যানথ্রোবট যা শরীরের ভেতরে স্বতঃস্ফূর্তভাবে চলাচলের মাধ্যমে ক্ষতস্থান নিরাময়ের মত জটিল কাজ করতে সক্ষম।
যুক্তরাষ্ট্রের মিডফোর্ডের টাফটস ইউনিভার্সিটির একদল গবেষক এই ক্ষুদ্র জৈবিক রোবট (কোনো জৈবিক উপাদান যেমন কোন প্রাণীকোষ দিয়ে সরাসরি তৈরি করার রোবট) তৈরি করেছে যা মানবদেহের ট্রাকিয়ার কোষ থেকে তৈরি। এর নাম অ্যানথ্রোবট (Anthrobot)।
অ্যানথ্রোবট শব্দটি এসেছে মানুষ এবং রোবট এই দুইটি শব্দ হতে। Anthro অর্থ মানব আর রোবট এর bot এই দুই মিলে অ্যানথ্রোবট।
এর পূর্বে ইউনিভার্সিটি অব ভার্মন্ট এর গবেষক মাইকেল লেভিন, জীববিজ্ঞানের অধ্যাপক, ভ্যানেভার বুশ এবং জোশ বনগার্ড কোষ দিয়ে রোবট বানানোর কাজ করেছেন। তারা জেনোবট নামক একটি ব্যাঙের ভ্রুণ কোষ থেকে বহুকোষী জৈবিক রোবট তৈরি করেছিলেন।
তাদের ওই জৈবিক রোবট আঁকাবাঁকা পথ অনুসরণ করে এগিয়ে চলা, আশপাশের পরিবেশের অবস্থা সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করা, আঘাত পেলে নিজেকে নিজেই নিরাময় করা এমনকি নিজেদের প্রতিলিপি তৈরি করার মতো ক্ষমতা রাখে। সেই সময় গবেষকরা জানতেন না যে এই ক্ষমতাগুলো শুধুমাত্র ভ্রুণকোষ থেকে পাওয়া জৈবিক রোবটেই আছে নাকি অন্য কোন প্রজাতির কোষ থেকেও এ ধরনের বায়োবট বানানো সম্ভব।
বর্তমানে গবেষণা যেখানে মাইকেল লেভিন এর সাথে জিজেম গুমুস্কায়াব নামে একজন পিএইচডি শিক্ষার্থী সম্মিলিতভাবে কাজ করেছেন, এখানে তারা দেখিয়েছেন কোন প্রকার জেনেটিক পরিবর্তন ছাড়াই প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের কোষ দিয়েও এ ধরনের জৈবিক রোবট তৈরি করা সম্ভব।
গবেষকরা দেখেছেন অ্যানথ্রোবটগুলো নতুন নতুন বহুকোষীয় গঠন তৈরির পাশাপাশি গবেষণাগারে বেড়ে ওঠা মানব নিউরনের পৃষ্ঠের উপর ও চলাচল করতে পারে এবং নিউরনের বিভিন্ন ক্ষত থেকে হওয়া ফাঁকা স্থানগুলো পূরণ করতে পারে। যা নিউরনের বিকাশে সাহায্য করে।
তবে ঠিক কীভাবে অ্যানথ্রোবটগুলো বৃদ্ধি ও বিকাশে সাহায্য করে তা এখনো স্পষ্ট নয়। কবে সরকার এটি নিশ্চিত করেছেন যে অ্যানথ্রোবটগুলো এখানে একত্রিত আচ্ছা দিত এলাকা তৈরি করে সেখানে নিউরন বৃদ্ধি পায়, যাকে “সুপারবট” নাম দেয়া হয়েছে।
মাইকেল লেভিন বলেছেন,
“পরীক্ষাগারে আমাদের তৈরি করা কোষগুলোর ক্ষমতা ল্যাবের তুলনায় মানবশরীরে আরো বেশি কার্যকর হয়ে উঠে।”
তিনি আরো বলেন,
“এটি অবিশ্বাস্য যে এগুলো রোগীর ডিএনএ তে কোনরকম পরিবর্তন কিংবা ক্ষতি না করে সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে চলাচল করতে পারে এবং ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চলে নিউরনের বৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করে। আমরা খোঁজার চেষ্টা করছি কিভাবে এই নিরাময় প্রক্রিয়া কাজ করে এবং অ্যানথ্রোবটগুলো আরো কী কী কাজ করতে পারে।”
মানবকোষ ব্যবহার করে এ ধরনের রোবট বানানোর সবচেয়ে বড় সুবিধা হল রোগীর কোষ ব্যবহার করেই অ্যানথ্রোবট তৈরি করা যাবে। এতে করে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সংক্রান্ত জটিলতা নিয়েও চিন্তা করা লাগবে না। কোনো প্রকার পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া ছাড়াই করা সম্ভব হবে।
পাশাপাশি শরীরে বাইরে এই অ্যানথ্রোবটগুলো অনিয়ন্ত্রিতভাবে বৃদ্ধি পাওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই কেননা পরীক্ষাগারে নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতেই এরা বেঁচে থাকতে পারে। পরীক্ষাগারে নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থা না পেলে অ্যানথ্রোবটগুলো আর টিকে থাকতে পারেনা এবং পুনরায় সক্রিয়ও হতে পারে না। সর্বোপরি, রোগীর ক্ষতিগ্রস্ত কোন কোষের পুনর্গঠনে তথা চিকিৎসায় এসব অ্যানথ্রোবটগুলোর ব্যবহার সম্পূর্ণরূপে ঝুঁকিহীন।
অ্যানথ্রোবটগুলো প্রত্যেকটি শুরুতে একক কোষ হিসেবে থাকে, একটি প্রাপ্তবয়স্ক শ্বাসনালীর পৃষ্ঠ থেকে কোষ নেয়া হয় এবং তা সিলিয়া নামক লোম সদৃশ দিয়ে আবৃত থাকে যা সামনে পিছনে ঢেউ তোলা। এই সিলিকাগুলো শ্বাসনালীর কোষে থাকা ক্ষুদ্র কণাগুলোকে ঠেলে পথ তৈরি করে দেয়।
পরবর্তী গবেষণাগুলোতে দেখা গেছে, কোষগুলো যখন ল্যাবে বৃদ্ধি পেতে থাকে তখন তারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে অর্গানাইড নামক গোলক আকৃতির বহু কোষী গঠন তৈরি করে।
গবেষণাদলটি এমন একটি অবস্থা তৈরি করেছে যার ফলে সিলিয়া অর্গানাইড এর বাইরের দিকে মুখ করে থাকে। এ অবস্থায় তারা কয়েকদিনের মধ্যেই ঘোরাফেরা করতে শুরু করে। তারা বিভিন্ন ধরনের আকার ধারণ করতে থাকে যাকে বায়োরোবট এর আচরণ বলা যায়।
মাইকেল লেভিন আরো বলেন যদি অ্যানথ্রোবটগুলোতে আরো নতুন সব বৈশিষ্ট্য যুক্ত করা যায় তাহলে এগুলো বিভিন্ন কোষের প্রভাব, পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে নেওয়া এবং সেই অনুযায়ী আকৃতিতে যাওয়া, মানবদেহে সহজে ভ্রমণের মাধ্যমে চিকিৎসার কাজে আরো ভালোভাবে সহায়তা করতে পারবে।
অ্যানথ্রোবটগুলোর মধ্যে কিছু গোলাকার সম্পূর্ণরূপ সিলিয়া দ্বারা আচ্ছাদিত। কিছু আছে যেগুলো নিয়মিত আকৃতির। কিছু অ্যানথ্রোবট আবার পাশে সিলিয়া দিয়ে আচ্ছাদিত। সম্পূর্ণরূপে বায়োডিগ্রেড হবার আগে প্রায় ৪৫-৬০ দিন পর্যন্ত পরীক্ষাগারে কার্যকর অবস্থায় থাকে।
নিউ জার্সি ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজিতে সাইমন গার্নিয়ারের সহায়তায় একটি গবেষণাদল বিভিন্ন ধরণের অ্যানথ্রোবটকে চিহ্নিত করেছে। তা দেখিয়েছে অ্যানথ্রোবট সর্বনিম্ন ৩০ মাইক্রোমিটার থেকে সর্বোচ্চ ৫০০ মাইক্রোমিটার পর্যন্ত আকৃতির হতে পারে। এমনকি এদের গতিবিধি পার্থক্য রয়েছে। বলাই যায় এই আবিষ্কার ন্যানোটেজিলোজির জটিল শাখায়ও গুরুত্বপূর্ণ একটি ভূমিকা পালন করবে।
অ্যানথ্রোবটের এই আবিষ্কার সামনের দিনগুলোতে চিকিৎসা বিজ্ঞানে আনবে নতুনত্ব এবং অস্ত্রোপচার হবে আরও অনেক সহজ এবং নিখুঁত এই আশা করাই যায়।
জুম্মান আল সিয়াম / নিজস্ব প্রতিবেদক
তথ্যসূত্র: ন্যাচার.কম, সায়েন্টিফিক আমেরিকান, নাউ.টাফটস.এডু