মানুষ প্রতি বছর ৩০০ মিলিয়ন টন প্লাস্টিক উৎপাদন করছে। প্লাস্টিক যেহেতু পচনশীল নয়, তাই ব্যবহারের পর যেসব প্লাস্টিক ফেলে দেয়া হয় তার অধিকাংশই যুগের পর যুগ একইভাবে পরিবেশে টিকে থাকছে। প্লাস্টিক দূষণের কারণে আমরা এখন জলবায়ু সংকটের ভেতর দিয়ে যাচ্ছি।
হয়তো প্রকৃতির কাছেই আমাদের এই বিপুল পরিমাণ প্লাস্টিক বর্জ্য নিষ্কাশনের উপায় আছে। আসলেই কি তাই?
গ্যালারিয়া মেলোনেলা (Galleria Mellonella) যারা সাধারণত ‘গ্রেট ওয়াক্স মথ’ বা ‘হানিকম্ব মথ’ নামে পরিচিত, তারাই হতে পারে পলিথিন বা প্লাস্টিক দূষণ থেকে বাঁচার প্রাকৃতিক উপায়। গ্যালারিয়া মেলোনেলা নামক এই শুঁয়োপোকা পলিইথিলিন খেতে অনেক পছন্দ করে। এই পলিইথিলিনগুলো বিশ্বব্যাপী সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত প্লাস্টিকগুলোর একটি যা অনুজীবের প্রভাবে পচে না। এই প্রজাতির শুঁয়োপোকা প্রতি বছর ৩০০ মিলিয়ন টন প্লাস্টিক বর্জ্য নিষ্কাশন করে এই সমস্যার সমাধান দিতে পারে।
আরও পড়ুনঃ
১। সমুদ্রে প্রতিবছর যুক্ত হওয়া প্লাস্টিক বর্জ্য: কিভাবে ক্ষতি করছে পরিবেশের? ২। থ্রিডি প্রিন্টেড অঙ্গ বাঁচাবে হাজারো প্রাণ ৩। প্রযুক্তির নতুন চমক–ব্যাগে বহনযোগ্য ই-বাইক আবিষ্কার করলো জাপান |
২০১৭ সালে, গবেষকরা দুর্ঘটনাক্রমে এই শুঁয়োপোকাগুলো আবিষ্কার করেন। এই পোকাকে যে প্লাস্টিকের ব্যাগে সংরক্ষণ করা হয়েছিলো তারা সেই প্লাস্টিকের ব্যাগ খেয়ে ছোট ছোট ছিদ্র করে ফেলেছিলো। পাওলো বোম্বলি এবং ক্রিস্টোফার হাও এই বিষয়টি দেখে অনেক অবাক হন, তারা ব্যাগসহ পোকাগুলোকে পরীক্ষাগারে রাখেন এবং প্লাস্টিকের উপর পোকাগুলো কি করে তা পর্যবেক্ষণ করেন।
ফলাফল হিসেবে তারা দেখেন যে ১০০ টি শুঁয়োপোকা ১২ ঘন্টায় ৯২ মিলিগ্রাম পলিইথিলিন খেয়ে ফেলেছে। যদিও এটি তেমন বড় কোন পরিমাণ না তবে এটি অনুজীবের প্লাস্টিক পঁচানোর হারের থেকে অনেক বেশি। এর চেয়ে বড় কথা হলো এই শুঁয়োপোকা, যাদের ‘প্লাস্টিভোরস’ বলা হয় তারা প্রকৃতপক্ষে প্লাস্টিকটিকে হজম করে এর উপাদানকে শক্তিতে রূপান্তর করে।
গবেষকদের মতে, “এই বিষয়টির রহস্য শুঁয়োপোকাগুলোর নিজস্ব বাস্তুতন্ত্রের মধ্যে থাকতে পারে। এরা খাবার হিসেবে মউচাক এবং মোম খেয়ে বেঁচে থাকে। পোকাগুলো তাদের চাকের ভিতরে ডিম দেয়, যেখানে পিউপা অবস্থার মথগুলো মোম খেয়ে বেড়ে উঠে।” এই তথ্যটি কারেন্ট বায়োলজি জার্নালে প্রকাশিত হয়েছিল।
এগুলো লার্ভা পর্যায়ে সবচেয়ে বেশি ক্ষুধার্ত থাকে।
তারা খাবার হিসেবে যে মোম গ্রহন করে তা লিপিড যৌগগুলির বিচিত্র মিশ্রণ দিয়ে গঠিত। এই মোমের সাথে পলিইথিলিনের রাসায়নিক গঠনের অনেক মিল আছে, তাই পোকাগুলো সহজেই পলিইথিলিন খেয়ে হজম করে ফেলতে পারে। এই শুঁয়োপোকার অন্ত্রে থাকা অণুজীবগুলি তাদের প্লাস্টিক খেয়ে হজম করতে সহায়তা করে। ওয়াক্স ওয়ার্ম বা শুঁয়োপোকা গুলো পলিইথিলিন খাওয়ার পর তা বিপাকীয় ক্রিয়ার মাধ্যমে গ্লাইকলে পরিণত হয় যা বায়োডিগ্রেডেবল।
গবেষকরা লক্ষ্য করেছেন যে শুঁয়োপোকার অন্ত্রে তাদের প্রাকৃতিক খাবার খাওয়ার সময় যতটুকু মাইক্রোবিয়াল দেখা যায় তারচেয়ে পলিইথিলিন খাওয়ার সময় মাইক্রোবিয়ালের পরিমান বেশি থাকে। কিন্তু এই পোকার মধ্যে প্লাস্টিকের বিপাক প্রক্রিয়া কীভাবে কাজ করে এবং প্লাস্টিক খাওয়ার ফলে এটা তার স্বাস্থ্যের কেমন ক্ষতি করে তা এখনও অস্পষ্ট।
গবেষকরা যদি বের করতে পারেন শুঁয়োপোকার অন্ত্রের ব্যাকটেরিয়ায় এমন কি আছে যা তাদেরকে সহজেই প্লাস্টিক হজম করে ফেলতে সহায়তা করে তবে এটি পরিবেশ থেকে প্লাস্টিক নির্মূল করার আরও ভাল উপায় বের করতে সাহায্য করবে। তারা আশা করছেন যে পোকাগুলোর এই প্লাস্টিক হজম করার প্রক্রিয়াটিকে বিশ্লেষণ করে পুনর্গঠন করা গেলে তা হবে প্লাস্টিক বর্জ্য নিষ্কাশনের জন্য জৈব-প্রযুক্তিগত সমাধান।
কিন্তু আমরা যদি পোকাগুলোকে সরাসরি প্লাস্টিক নিষ্কাশনে সরাসরি ব্যবহার করতে চাই তবে তারা কেবল অল্প কিছুই করতে পারবে। এই পোকাগুলো থেকে আমরা প্লাস্টিক বর্জ্য নিষ্কাশনের উপায় বের করতে পারি তবে তাদের নিজেদের দিয়ে বর্জ্য নিষ্কাশনের চিন্তা করা বোকামি। কারণ ৬০টি শুঁয়োপোকার একটি দল দেশলাই-বাক্সের আকারের একটি প্লাস্টিকের টুকরো খেতে এক সপ্তাহ লেগে যায়। এটি কোন বড় সমাধান নয়, তবে এটি একটি ছোট শুরু।
নিশাত তাসনিম/ নিজস্ব প্রতিবেদক