আপনাকে যদি বলা হয় আমাদের পূর্বপুরুষেরা নরখাদক ছিলেন তাহলে কি আপনি অবাক হবেন? জ্বি হ্যাঁ, সম্প্রতি প্রকাশিত এক গবেষণায় ঠিক এমনই এক চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে এসেছে। আমাদের প্রাচীন পূর্বপুরুষেরা হয়তো নরখাদক ছিলেন বলে দাবি করছেন বিজ্ঞানীরা।
স্মিথসোনিয়ান ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীগণ কেনিয়ায় আবিষ্কৃত প্রায় দেড় মিলিয়ন বছর পুরানো প্রাচীন মানবগোষ্ঠীর অন্তর্গত একজন ব্যক্তির বাম টিবিয়ায় (হাঁটুর নিচ থেকে পায়ের অংশের মোটা হাড়বিশেষ) নয়টি কাঁটা চিহ্ন খুঁজে পেয়েছেন যা পাথরের তৈরি কোনো অস্ত্র থেকে সৃষ্ট বলে জানান বিজ্ঞানীরা। হাড়টিতে আরও দুটি ক্ষতচিহ্ন ছিল যা সম্ভবত কোনো বিড়ালের কামড়ের চিহ্ন।
![Science Bee Science News](https://www.sciencebee.com.bd/daily-science/efylucmy/2023/08/dddd_11zon-300x169.jpg)
গবেষণার প্রধান পরিচালক ড. ব্রায়ানা পবিনার জানান,
“হাড়টিতে প্রাপ্ত কাঁটা চিহ্ন অনেকটাই প্রাচীন যুগে যেসকল প্রাণী ভক্ষণ করা হতো সেসকল প্রাণীর ফসিলে যে ধরনের কাঁটা চিহ্ন পাওয়া গেছে তার সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ।”
অর্থাৎ বিজ্ঞানীরা মনে করছেন অতীতে আমাদের পূর্বপুরুষেরা পুষ্টির জন্য একে অন্যকে ভক্ষণ করতো। বিজ্ঞানীদের এই দাবি নরখাদক বা ক্যানিবালিজমের ধারণায় এক অনন্য মাত্রা যোগ করতে যাচ্ছে।
একজন মানুষের পেশির মোট পুষ্টিমান ৩২৩৭৬ ক্যালরি (বর্তমান মানুষের হিসাবে), যেখানে মানুষ বা আদি মানবগোষ্ঠী কর্তৃক ভক্ষণকৃত অন্যান্য প্রাণীর পুষ্টিমান ছিল এর চেয়ে অনেক বেশি।
![Science Bee Science News](https://www.sciencebee.com.bd/daily-science/efylucmy/2023/08/cannibal3_1_11zon-300x200.jpg)
যদিও আদি মানবদেহের পুষ্টিমান কত ছিল তা সঠিক জানা যায়নি, তবে ধারণা করা হয় তৎকালীন অন্যান্য প্রাণীর তুলনায় স্বাভাবিকভাবেই সেটা কম। যেমন একটি ম্যামথ, পশমি গন্ডার ও লাল হরিণের পেশির পুষ্টিমান যথাক্রমে ৩৬০০০০০, ১২৬০০০০ ও ১৬৩৬৮০ ক্যালরি।
কাজেই আমাদের আদিপুরুষেরা পুষ্টির চাহিদা মেটাতে নরখাদক হয়েছিলেন এই থিওরি ক্যানিবালিজমের ধারণায় এক বিরাট অধ্যায়ের সূচনা করতে যাচ্ছে। যদিও নিছক চাহিদার জোগান দিতে নরমাংস ভক্ষণের ধারণা বিশ্বাস করা কিছুটা কষ্টকর, তবে উক্ত গবেষণার ফলাফল কিন্তু সেদিকেই নির্দেশ করছে।
ক্যানিবালিজম, সহজ ভাষায় বলতে গেলে নরমাংস ভক্ষণ – আদি নৃশংসতার এক ভয়াবহ নিদর্শন। এটি এমন এক পরিস্থিতিকে নির্দেশ করে যেখানে সভ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ, সত্য যেখানে অনাকাঙ্ক্ষিত।
নরমাংস ভক্ষণ প্রথা আমাদের আদি মানবগোষ্ঠী থেকে বর্তমান সমাজ পর্যন্ত সময়ের সবচাইতে বর্বর ও ঘৃণ্য প্রথাগুলোর একটি। সমগোত্রীয় প্রাণীদের খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করা, আরো স্পষ্টভাবে বলতে গেলে মানুষ হয়ে মানুষের মাংস ভক্ষণ করা- ক্যানিবালিজম শব্দের প্রকৃত অর্থ বহন করে।
ক্যানিবালিজমের মতো নিন্দিত ও বর্বর প্রথা সূদুর অতীতই নয়, বর্তমান সভ্য পৃথিবীতেও এখনও পালিত হয়ে থাকে। লিবিয়া ও কঙ্গোতে কিছু যুদ্ধে ক্যানিবালিজমের চর্চা হতে দেখা গিয়েছে। করোওয়াই উপজাতি এখনও বিশ্বাস করে নরমাংস ভক্ষণ তাদের সংস্কৃতিরই একটি অংশ। কিছু মিলেনেশিয়ান উপজাতি এখনো তাদের ধর্মচর্চায় ও যুদ্ধে ক্যানিবালিজমের চর্চা করে থাকে।
এছাড়াও আন্দিজ ট্র্যাজেডির কথা আমরা সকলেই কমবেশি জানি যেখানে বিমান দূর্ঘটনার কবলে পড়ে ৭২ দিন দূর্গম পাহাড়ে আটকে থাকা ১৬ জন যাত্রী বেঁচে থাকার তাগিদে তাদের সহযাত্রীদের মাংস ঝলসিয়ে খেতে বাধ্য হয়েছিলেন।
![Science Bee Science News](https://www.sciencebee.com.bd/daily-science/efylucmy/2023/08/lll_11zon_11zon-300x200.jpg)
অর্থাৎ ক্যানিবালিজম কিংবা নরমাংস ভক্ষণের কারণ হিসেবে আমরা বলতে পারি ধর্মীয় রীতি, সামাজিক প্রথা, খাদ্যের চরম সংকট অথবা যুদ্ধক্ষেত্রে নিজেদের কর্তৃত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠা।
তবে ড.ব্রায়ানা পবিনার ও তার টিমের দাবি সত্য প্রমাণিত হলে এ আবিষ্কার ক্যানিবালিজমের ধারণাকে আরও পোক্ত করবে, সেই সাথে মানব নৃশংসতাকে নিয়ে যাবে আরও একধাপ উপরে।
যদিও এখনও নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না হাড়টি ঠিক কোন প্রাচীন মানবগোষ্ঠীর। তাই এটি ক্যানিবালিজম নাকি কাছাকাছি কোনো গোত্রের প্রাণীর মাংস ভক্ষণের ঘটনা তা নিয়ে কিছুটা ধোয়াশা থেকেই যাচ্ছে। তবে গবেষণায় দাবি করা হচ্ছে নিশ্চিতভাবেই প্রায় দেড় মিলিয়ন বছর পূর্বে প্রাচীন মানবগোষ্ঠীর প্রজাতিকে মানুষ কিংবা মানুষের মতো প্রজাতি ভক্ষণ করেছিলো।
ড.পবিনার বলেন,
“আমাদের প্রাপ্ত তথ্যানুসারে হোমিনিনরা সম্ভবত কমপক্ষে ১.৪৫ মিলিয়ন বছর পূর্বে পুষ্টির চাহিদা পূরণে অন্যান্য হোমিনিনদের ভক্ষণ করতো।”
তিনি আরো জানান,
“মানব বিবর্তনবৃক্ষের প্রজাতিদের মাঝে আরও অনেক উদাহরণ রয়েছে যেখানে পুষ্টির জন্য একে অপরকে ভক্ষণ করা হতো। কিন্তু কেনিয়ায় আবিষ্কৃত এই জীবাশ্মটি ইঙ্গিত করে যে হোমিনিড প্রজাতি আমাদের সর্বশেষ স্বীকৃত সময়ের চেয়েও আরো অনেক আগের থেকেই বেঁচে থাকার জন্য একে অপরের মাংস ভক্ষণ করতো।”
ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়ামের মানব বিবর্তনের একজন গবেষক অধ্যাপক স্ট্রিংগার-যিনি গবেষণার সাথে যুক্ত ছিলেন না- একটি সাক্ষাৎকারে জানান যে প্রমাণগুলো বৈজ্ঞানিকভাবে সঠিক বলে তিনি মনে করেন এবং এটি খুব প্রাচীন মানুষদের মাঝে ক্যানিবালিজমের ধারণার পক্ষে একটি জোড়ালো প্রমাণ।
তিনি আরও জানান ড. পবিনার ও তার টিমের প্রাপ্ত প্রমাণাদি সম্ভবত প্রাচীনতম নরখাদকের প্রমাণ নয়। যেহেতু দক্ষিণ আফ্রিকায় স্টারকফন্টেইন থেকে প্রাপ্ত একটি জীবাশ্মের চোয়ালের হাড়ের ওপরেও কাঁটা দাগ পাওয়া গেছে যা প্রায় দুই মিলিয়ন বছর পুরানো।
![Science Bee Science News](https://www.sciencebee.com.bd/daily-science/efylucmy/2023/08/900-300x292.jpeg)
তবে উক্ত জীবাশ্মটির প্রাচীনত্ব এবং সৃষ্ট কাঁটা দাগগুলোর কারণ (কোনো মানুষ বা মানব সমগোত্রীয়ের সৃষ্ট অথবা পাথুরে মেঝের আঘাতে সৃষ্ট) সম্পর্কে বৈজ্ঞানিক ক্ষেত্রগুলোতে তীব্র বিতর্ক রয়েছে।
ড. পবিনার আশা করছেন দক্ষিণ আফ্রিকায় প্রাপ্ত জীবাশ্মটির শীঘ্রই পুনঃবিশ্লেষণ করা হবে যাতে করে নিশ্চিত হওয়া যায় হোমিনিড ক্যানিবালিজম আসলে দেড় নাকি দুই মিলিয়ন বছর পূর্বের।
তবে ফলাফল যাই হোক না কেন, এটি নিঃসন্দেহে মানুষের আদি বর্বরতার এক অত্যন্ত কালো অধ্যায়কে সামনে টেনে আনবে যা যতটা না ঘৃণ্য তারচেয়ে অনেক বেশি আতঙ্কের। আমাদের পূর্বসুরিদের বৈশিষ্ট্য তো আমরাও জিনে ধারণ করে আছি, তাই না?
তাসমিয়া আহমেদ হিয়া / নিজস্ব প্রতিবেদক
তথ্যসূত্র: টেলিগ্রাফ, ঢাকা ট্রিবিউন, দ্য ভার্জ
+1
+1
3
+1
+1
+1
5
+1
2
+1
3