ছোটবেলায় বালতি বা গামলায় পানি নিয়ে তার উপর আলতো করে হাত বুলিয়ে কতকিছু লেখার চেষ্টা করেছি আমরা অনেকে। কিন্তু আমাদের সেই চেষ্টা বারবার ব্যর্থ হয়েছে। কিন্তু অবশেষে বিজ্ঞানীরা এবার পানির উপর শব্দ লেখার পদ্ধতি আবিষ্কার করেছেন। ইতিহাসে প্রথমবারের মতো তরলের উপর শব্দ লিখতে সক্ষম হয়েছেন বিজ্ঞানীরা।
তরলের উপর শব্দ লিখতে গবেষকরা যে পদ্ধতিটি ব্যবহার করছেন সেটির নাম হলো ডিফিউসিওসমোসিস। এই পদ্ধতি ব্যবহার করে সরাসরি তরল পানির উপর পরিষ্কার এবং দীর্ঘস্থায়ী দাগ সৃষ্টি করা সম্ভব এবং দাগগুলো তরলের পৃষ্ঠের ঠিক নিচে ভাসমান অবস্থায় থাকবে।
Nano Micro Small জার্নালে ২১ শে আগস্ট ২০২৩ তারিখে প্রকাশিত নতুন এই গবেষণায় জার্মানির ইউনিভার্ডাসিটি অব ড্যামস্টাড এবং জনানেস গুটেনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটির বেনো লিবচেন এবং সহকর্মীরা তরলের ভিতরে দীর্ঘস্থায়ী লেখা তৈরি করার এই পদ্ধতি সম্পর্কে ব্যাখ্যা করেছেন।
ডিফিউসিওসমোসিস শব্দটিকে ভাঙলে মূলত দুইটি আলাদা শব্দ পাওয়া যায়। যার একটি ডিফিউশন মানে ব্যাপন, অন্যটি ওসমোসিস বা অভিঃস্রবণ। মূলত ব্যাপন ও অভিঃস্রবণ প্রক্রিয়ার সমন্বয়কে কাজে লাগিয়ে একটি তরল মিশ্রণের মধ্যে বিভিন্ন ঘনত্বের কণাকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে পরিচালিত করে একটি নতুন ঘনত্বের পার্থক্য সৃষ্টি করা হয় যা তরলের পৃষ্ঠের ঠিক নিচে দাগের মতে সৃষ্টি করে।
এক্ষেত্রে কম ঘনত্বের চার্জযুক্ত তরল মিশ্রণটি ‘কাগজ’ হিসাবে কাজ করে। ‘কালি’ হিসেবে ব্যবহার করা হয় বড় কলয়েডাল কণা যা সম্পূর্ণ দ্রবণে পাতলাভাবে ছড়িয়ে পড়তে সক্ষম। ‘কলম’ হিসেবে ব্যবহার করা হয় এরকম গুটিকা যা একটি একক ছোট আয়ন বিনিময় করতে পারে।
কলমটি প্রকৃতপক্ষে এমন একটি কণা, যা তরল মিশ্রণে চার্জযুক্ত কণাগুলোকে অন্যান্য বিভিন্ন ছোট চার্জযুক্ত কণার সাথে বিনিময় করতে সক্ষম। মানে বিষয়টা এরকম, কলমের কাজটা হলো পানির বা তরলের কণাগুলোকে সরিয়ে তরল মিশ্রণে অবস্থিত কালি হিসেবে যে কণাগুলা আছে সেগুলোকে প্রতিস্থাপন করা।
গবেষণাটির পরিচালক লিবচেন সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন,
“গবেষকরা যখন তরলের ছোট আয়নগুলোর সাথে কালি হিসেবে ব্যবহৃত বড় আয়নগুলো বিনিময় করেন, তখন ছোট আয়নগুলো দ্রুত সরে যায় (প্রসারিত হয়) এবং এটি ঘনত্বের পার্থক্য সৃষ্টি করে। এই ঘনত্বের পার্থক্য তরলকে কন্টেইনারের নীচের অংশে জোর করে নিয়ে যায়। তখন সেই চলমান তরলটি তার সাথে দৃশ্যমান আঠালো কণা (কালি) বহন করে নিয়ে যায়। ফলে তরলের পৃষ্ঠের ঠিক নিচে বিভিন্ন প্যাটার্ন বা দাগ এর সৃষ্টি হয়।”
এখন আমাদের অনেকের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে যে,
তরলের উপর এত জটিল প্রক্রিয়া চালানোর সময় যদি তরল আলোড়িত করতে হয় তাহলে লিখাটি নষ্ট হয়ে যাবে কিনা?
লিবচেন এ ব্যাপারে বলেন,
“উত্তর হলো, না। কারণ কলমটি ছোট, এটি আশেপাশের দ্রাবককে খুব বেশি আলোড়িত করে না। কলম বড় হলে জল উত্তেজিত হবে এবং আপনি যা লিখেছেন তা ধ্বংস করতে পারবে। এছাড়া পরীক্ষার সময় স্কেলের মধ্যে স্থির জলকে অনেক বেশি সরানোর জন্য ব্যবহৃত কলয়ডাল কণাগুলো খুব বড় এবং ভারী হওয়ায় রেখাগুলো দীর্ঘসময় দৃশ্যমান থাকে।”
তিনি আরও বলেন,
“পরীক্ষাটি পরিচালনা করা কোনো সহজ বিষয় ছিল না। কালি হিসেবে ব্যবহৃত কণাগুলো নির্বাচন করা বেশ জটিল একটি কাজ। এক্ষেত্রে কণাগুলো খুব বেশি ছোট হয়ে গেলে লেখাগুলো বা প্যাটার্নগুলো স্পষ্টভাবে দেখা যেত না, আবার খুব বেশি বড় হলে চলমান তরলকে অনুসরণ করতো না। ফলে প্যাটার্নও তৈরি হতো না।”
তবে যা-ই হোক, গবেষণাটি পরিচালনাকারী দলটি বর্তমানে আরও বিভিন্নভাবে তরলের উপর লেখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। বর্তমান পরীক্ষাটিতে মহাকর্ষকে কাজে লাগিয়ে কলম কাজে লাগানো হয়েছে। পরবর্তী পরীক্ষাগুলো মহাকর্ষের পরিবর্তে তারা চৌম্বকত্ব অথবা তড়িৎক্ষেত্রকে কাজে লাগাতে ইচ্ছুক।
আসিফুল হাসান আসিফ / নিজস্ব প্রতিবেদক