আমরা রসায়নে রস খুঁজে না পেলেও আয়নের উপস্থিতি ঠিকই খুঁজে পাই। এই যে রসায়নের ক্রিয়া বিক্রিয়া নিয়ে আমরা শঙ্কিত, সেই রসায়ন ৫০০০ বছর পূর্বে ভারতবর্ষে কাপড়কে আকর্ষণীয় করে তুলতে ব্যবহার হতো। নিজেদের অজান্তে কিংবা জেনেশুনেই এর ব্যবহারিক চর্চা হয়ে এসেছে বহুকাল আগে থেকেই। খ্রিষ্টপূর্ব ৩৫০০ অব্দের দিকে অস্ত্র তৈরি করতে কপার আর টিনকে গলিয়ে ব্রোঞ্জ তৈরি কিংবা বহুল আলোচিত মিশরের পিরামিডের গর্ভে থাকা একেকটা মমি রসায়নের গুণকীর্তন-ই করে থাকে।
সবকিছু ছাপিয়ে জাবির ইবনে হাইয়ানের অসংখ্য গ্রন্থও বলে দেয় রসায়নের চর্চা বহুকাল আগ থেকেই একাগ্রতার সাথে করে এসেছে মানবসভ্যতার একেকজন রসায়নবিদ। আর তাদের চর্চার ফলে আজকে হাতের নাগালে অনেক রোগের ঔষধ। দৈনন্দিন ব্যবহৃত প্রতিটি জিনিস থেকে শুরু করে ফসল ফলানোর কীটনাশক সহ যাবতীয় পদার্থের মাঝেই দেখা মিলে রসায়নের আয়নের খেলা। দিনদিন প্রযুক্তির উন্নয়নের সাথে সাথে বিজ্ঞানীরাও আবিষ্কার করছেন নতুন অনেক কিছু, যার মাধ্যমে আমরা দৈনন্দিন জীবনে পাচ্ছি রসায়নের আরো অনেক সুফল। তেমনই একটি হলো এই বছর, ২০২২ সালে রসায়নে নোবেল পুরষ্কার বিজয়ী গবেষণার মূল বিষয়, ক্লিক এবং বায়োঅর্থোগোন্যাল কেমেস্ট্রি।
১৯০১ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে ১৯১ জন বিজ্ঞানীকে রসায়নে নোবেল পুরষ্কার দেওয়া হয়েছে। তারই ধারাবাহিকতায়, ২০২২ সালে বিজয়ী হয়েছেন ক্যারোলিন আর. বার্টোজি, মর্টেন মেলডাল ও কে. ব্যারি শার্পলেস। নোবেল কমিটি জানিয়েছে, `ক্লিক কেমেস্ট্রি’ ও ‘বায়োঅর্থোগোন্যাল কেমেস্ট্রি’ -র উন্নয়নে অবদান রাখায় তাদেরকে রসায়নে নোবেল পুরস্কারে পুরস্কৃত করা হয়েছে। নোবেল কমিটির পরামর্শে রাজকীয় সুইডিশ বিজ্ঞান অ্যাকাডেমি এই পুরস্কারটি প্রদান করে। প্রতিবছর আলফ্রেড নোবেলের মৃত্যু তারিখ ১০ ডিসেম্বর সুইডেনের রাজধানী স্টকহোম থেকে রসায়নে নোবেল পুরস্কার প্রদান করা হয়।
আসুন জেনে নিই ক্লিক এবং বায়োঅর্থোগোন্যাল কেমেস্ট্রি কী?
ক্লিক কেমেস্ট্রি (Click Chemistry):
ক্লিক কেমেস্ট্রি এমন একটা পদ্ধতি যেটা প্রাথমিকভাবে কার্বন-হেটেরো গঠন প্রতিক্রিয়া দ্বারা উচ্চ ফলন এবং নির্দিষ্ট পণ্য প্রদানকারী বিক্রিয়াগুলোকে বর্ণনা করে থাকে। এ বিক্রিয়ায় এত পরিমাণে বিক্রিয়ক নির্দিষ্ট যে, যেকোনো দুটি বিক্রিয়ককে যুক্ত করতে চাইলে বিক্রিয়ক দুটির দুই প্রান্তে অ্যালকাইন ও অ্যাজাইড অণু যোগ করে দিলেই কাজ শেষ। কপারের উপস্থিতিতে হুট করে তারা জোড়া লেগে যাবে। এ যেন এক ক্লিকেই সমাধান! তবে এটির জন্য তাপীয় অনুকূল পরিবেশ হতে হবে এবং যা কমপক্ষে ২০ কিলোক্যালারি/মোলের একটি এনথালপিক চালিকা শক্তি।
২০০১ সালে শার্পলেস এবং তার সহকর্মীর দ্বারা প্রবর্তিত হয় এটি। অপরদিকে ২০০২ সালে এই একই বিষয়ে স্বতন্ত্রভাবে গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন মর্টেন মেলডান। যেখানে রয়েছে ওষুধের অণুগুলির সংশ্লেষণের একটি নতুন সহজ পদ্ধতি যার ব্যবহারিক এবং নির্ভরযোগ্য ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ব্যবহার করে বর্তমানে ওষুধ আবিষ্কারের প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করা যাচ্ছে।
বায়োঅর্থোগোন্যাল কেমেস্ট্রি:
বায়োঅর্থোগোন্যাল কেমেস্ট্রি বলতে যেকোনো জীবিত সিস্টেম বা প্রাণির ভেতরে ঘটা দ্রুত ও তাৎক্ষণিক রাসায়নিক বিক্রিয়াগুলোকে বুঝায়, যা সেই পরিবেশে ইতোমধ্যেই উপস্থিত বা ঘটতে থাকা রাসায়নিক কার্যকলাপের উপরে কোনো প্রভাব না ফেলেই অগ্রসর হয়। মূল প্রতিক্রিয়া গুলির মধ্যে রয়েছে নেটিভ রাসায়নিক বন্ধন এবং স্টাউডিঞ্জার লাইগেশন, কপার-ক্যাটালাইজড অ্যাজাইড-অ্যালকাইন সাইক্লোঅ্যাডিশন, স্ট্রেন-প্রোমোটেড [3 + 2] বিক্রিয়া, টেট্রাজিন লাইগেশন, ধাতু-অনুঘটক যুগল বিক্রিয়া, অক্সাইম এবং হাইড্রাজোন লাইগেশনের পাশাপাশি বায়োগোনাল প্রতিক্রিয়া। বায়োঅর্থোগোন্যাল রসায়নের ‘ক্লিক কেমিস্ট্রি’-এর বৃহত্তর ক্ষেত্রের সাথে উল্লেখযোগ্য সংযুক্তি রয়েছে।
এখানে মূলত উচ্চ-ফলনশীল প্রতিক্রিয়া যা পরিধিতে বিস্তৃত এবং সম্পাদন করা সহজ সহ আলোচনা করা হয়েছে, যে কীভাবে বায়োঅর্থোগোন্যাল রসায়ন বায়োমেডিক্যাল ইমেজিং, ঔষধি রসায়ন, প্রোটিন সংশ্লেষণ, পলিমার বিজ্ঞান, পদার্থবিজ্ঞান এবং পৃষ্ঠতল বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে অপরিহার্য হয়ে উঠেছে।
বায়োঅর্থোগোন্যাল রসায়নের প্রয়োগগুলি বৈচিত্র্যময়। যেমন: এবং
- জেনেটিক কোড সম্প্রসারণ এবং বিপাকীয় প্রকৌশল,
- ওষুধের লক্ষ্য শনাক্তকরণ,
- অ্যান্টিবডি-ড্রাগ কনজুগেশন এবং ওষুধ সরবরাহ,
- প্রজননযোগ্যতা এবং ডেটা জমা করার মানগুলি বর্ণনা করে,
- বর্তমান সীমাবদ্ধতাগুলো কীভাবে নতুন গবেষণার দিকনির্দেশনা দিচ্ছে তার রূপরেখা দেয় এবং
- জীববিজ্ঞান এবং বায়োমেডিসিনের উদীয়মান সমস্যাগুলোতে বায়োঅর্থোগোন্যাল রসায়ন প্রয়োগের জন্য নতুন সুযোগ নিয়ে আলোচনা করে।
এই আবিষ্কারের ব্যাপারে ক্লিক কেমেস্ট্রি নিয়ে গবেষণা করে এবারে রসায়নে নোবেল বিজয়ীদের একজন, ক্যারোলিন আর. বার্টোজি বলেন, “আমাদের লক্ষ্য হলো মানবদেহের ভেতরের রাসায়নিক বিক্রিয়াগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করা, যেন আমরা নিশ্চিত করতে পারি ওষুধগুলো সঠিক স্থানে পৌঁছে কাজ করে এবং ভুল স্থান থেকে দূরে থাকে।
ক্লিক কেমেস্ট্রি আর বায়োঅর্থোগোন্যাল কেমেস্ট্রি যেনো পরিপূরকভাবে কাজ করছে। বহুল আলোচিত ক্লিক কেমেস্ট্রিকে ভিন্ন ভাবে এবং বহুল আঙ্গিকে ব্যবহারের পথ তুলে ধরেন বার্টোজি। ক্লিক বিক্রিয়াকে জীবদেহে কাজে লাগাতে চাইলেন তিনি। কিন্তু জীবকোষের জন্য কপার অত্যন্ত বিষাক্ত। তাই কপারের অনুপস্থিতিতে অ্যাজাইড ও অ্যালকাইনের সাহায্যে কীভাবে জীবকোষে ক্লিক বিক্রিয়া ঘটানো যায় সেটির সন্ধান পেলেন তিনি । এবং ২০০৪ সালে এ সামগ্রিক বিষয়ের গবেষণাপত্রটিও প্রকাশ করেছেন।
উল্লেখ্য: ব্যারি শার্পলেস ৫ম বিজ্ঞানী যিনি ২য় বারের মতো নোবেল পুরস্কার পেলেন। এর আগে ২০০১ সালে নোবেল পুরস্কার পান তিনি।
দিনকে দিন মানুষ অসম্ভবকে সম্ভব করেছে। বাস্তবে রূপান্তরিত করেছে লালিত স্বপ্নকে। অক্লান্ত শ্রম আর মেধা লাগিয়ে অনন্যমাত্রা যোগ করছে মানবসভ্যতায়। গত শতাব্দীতে যা কল্পনা মাত্র তা এ শতাব্দীতে এসে মানুষের হাতের ছোঁয়ায় অন্যমাত্রায়। শত প্রতিবন্ধকতা শেষে ঠিক এভাবেই একেকটা অর্জন জমা হোক মানবসভ্যতায়। জানান দিক মানবতার তরে বিজ্ঞান এবং এ-বিজ্ঞান শুধু কল্যাণের জন্যেই নিবেদিত হোক।
ছাইদুল ইসলাম শুভ/ নিজস্ব প্রতিবেদক
তথ্যসূত্র: নোবেলকমিটি, পলিমারডাটাবেইজ, phys.org, Bio orthogonal chemistry, Click Chemistry