আচ্ছা, কেমন হতো যদি আমরা দেহকোষের ভাষা বুঝতে পারতাম? কীভাবে কোষগুলো উদ্দীপিত হয়, নিয়ন্ত্রিত হয় এবং নতুন রক্তনালী তৈরি হয় সে সংকেত জানতে পারতাম? ব্যাপারটা নিঃসন্দেহে দারুণ হতো। কিন্তু, কোষের ভাষা অনেক বেশি জটিল। তাই সে ভাষা বুঝাটাও সহজ কিছু নয়।
কোষ কীভাবে উদ্দীপিত হয়, নিয়ন্ত্রিত হয় এবং কীভাবে নতুন রক্তনালী তৈরি হয়, সে প্রক্রিয়াটি এনজিওজেনেসিস নামে পরিচিত। প্রথমে গবেষকগণ ভেবেছিলেন, ক্যান্সার এবং এই জাতীয় অন্যান্য রোগের চিকিৎসায় এটি একটি চমৎকার সম্ভাবনা হিসাবে কাজ করবে, যার মাধ্যমে সেলুলার সংকেতগুলিকে বাধা দেওয়া এবং নতুন রক্তনালী বৃদ্ধি বন্ধ সফলে কিন্তু প্রথমেই বলা হয়েছে কোষের ভাষা যথেষ্ট সহজ নয়!
এনজিওজেনেসিস এর দারুণ কিছু কার্যকারিতাও আছে। যেমন ভ্রূণের বিকাশ এবং ক্ষত নিরাময়ের সময় নতুন রক্তনালীর বৃদ্ধি তাদের প্রয়োজনীয় টিস্যুতে সঠিক পুষ্টি সরবরাহ নিশ্চিত করে। আবার ইসকেমিক রোগ, যেমন স্ট্রোকের কারণে রক্তপ্রবাহ বিঘ্নিত হয়ে টিস্যুর ক্ষতি হলে স্থিতিশীল রক্তনালীগুলোর বৃদ্ধি, অক্সিজেন-বঞ্চিত টিস্যু পুনরুদ্ধারে সহায়তা করতে পারে।
তবে এনজিওজেনেসিসকে উদ্দীপিত করার ফলে রক্তনালীগুলি লিকেজ এবং স্ফীত হতে পারে, যা তাদের সঠিকভাবে পুষ্টি সরবরাহ করতে বাধা দেয়। এই কোষ-এর বৃদ্ধি বা রক্তনালীগুলোর পরিবর্তন কেবল ক্যান্সার, চোখের রোগ এবং ইস্কেমিক কার্ডিওভাসকুলার রোগের জন্য নয়, সেপসিস এবং সংক্রমণজনিত রোগ, যেমন কোভিড সহ অন্যান্য অবস্থার জন্যও প্রভাব বিস্তার করে।
এই রোগগুলোর চিকিৎসার জন্য এনজিওজেনেসিস ডিকোড করা, কোষগুলো কীভাবে সুস্থ হয় এবং কীভাবে রোগাক্রান্ত অবস্থায় রক্তনালীকে কন্ট্রোল ও রেগুলেট করে তার একটি সমন্বিত দৃষ্টিভঙ্গি প্রয়োজন। এনজিওজেনেসিস বিভিন্ন ধরণের কোষ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় যেখানে বিভিন্ন সিগন্যালিং পথ রয়েছে। যখন একটি কোষ সংকেত পায়, তখন এটি জৈব রাসায়নিক বিক্রিয়াগুলির একটি ক্যাসকেডকে ট্রিগার করে যা বিভিন্ন সেলুলার আচরণ এবং ফলাফলের দিকে পরিচালিত হয়।
এই গবেষণায় সিস্টেম বায়োলজি নামে একটি পদ্ধতি রয়েছে। জনস হপকিন্স ইউনিভার্সিটি স্কুল অব মেডিসিনে ডঃ আলেকজান্ডার পপেলের ল্যাবে সেল সিগন্যালিং নেটওয়ার্কগুলোকে ডিকোড করার জন্য সিস্টেম বায়োলজি পদ্ধতি ব্যবহার করা হয় যা এনজিওজেনেসিস নিয়ন্ত্রণ করে, সেলুলার সিগন্যালিং তৈরি করার জন্য পৃথক পথ এবং কোষের প্রকরণের উপর গবেষণাকে একত্রিত করে। এরপর সংকেতগুলোকে গাণিতিক সমীকরণে রূপান্তর করে তাদের সমাধান করার মাধ্যমে কোষের আচরণ অনুকরণ এবং ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়। এই মডেলগুলো জৈব রাসায়নিক বিক্রিয়া, সেলুলার সিগন্যালিং পাথওয়ে এবং সেল-টু-সেল কমিউনিকেশনের ধাপ ও জটিল প্রক্রিয়াগুলোর বিভিন্ন দিক একীভূত করে।
গবেষকেরা এখন পেরিফেরাল ধমনীর রোগের উপর নজর দিচ্ছেন। এখানে রক্তপ্রবাহ জমাট বাঁধলে তা বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গে ব্যথা সৃষ্টি করে। এর যথাযথ চিকিৎসা না করা হলে গ্যাংগ্রিন এবং অঙ্গচ্ছেদ পর্যন্ত হতে পারে। এই সেল সিগন্যাল ডিকোড করে বর্তমানে একটি ভার্চুয়াল এন্ডোথেলিয়াল সেল তৈরি করা হয়েছে যা স্থিতিশীল, লিকেজবিহীন রক্তনালীগুলোর বৃদ্ধিকে তরান্বিত করবে। পাশাপাশি এটি পেরিফেরাল ধমনী রোগের চিকিৎসার চাবিকাঠি হতে পারে।
গবেষকদল ভার্চুয়াল সিগন্যালিং পাথওয়ে, ভার্চুয়াল কোষ এবং ভার্চুয়াল টিস্যু তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন। যা এই সিগন্যালিং নেটওয়ার্কগুলোকে আরও বেশি পরিমাণে এর পরিবর্তনগুলোর প্রতি প্রতিক্রিয়ার সুস্পষ্ট ধারণা দেয়। গবেষণায়, কোষে আণবিক প্রক্রিয়া চিহ্নিতকরণ সম্ভব হয়েছে যা এনিজেনিওজেনেসিস এর সময় প্রতিরোধের চাবিকাঠি হতে পারে এবং এর লিকেজ প্রতিরোধে কাজ করবে। আশা করা যায় আবিষ্কারটি এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য থেরাপিউটিক কৌশলের বিকাশ করতে পারে।
ভার্চুয়াল মডেলিং এনজিওজেনেসিসের অস্পষ্ট ধারণাকে ধীরে ধীরে তীক্ষ্ণ করে তুলছে। এটি আরও নির্ভুলতার সাথে বুঝতে সাহায্য করেছে যে, কীভাবে ওষুধের ধরন এবং ডোজ মানবদেহে এনজিওজেনেসিসকে প্রভাবিত করতে পারে। এটি আমাদের আরও সঠিকভাবে জানাবে যে কীভাবে জিনোমিক পার্থক্যগুলো পরিবর্তনশীল স্বাস্থ্যের ফলাফলের দিকে পরিচালিত করে।
কম্পিউটেশনাল সিস্টেম বায়োলজি মডেল জটিল, কারণ কোষের ভাষা জটিল এবং এতে ঝুঁকি ও রয়েছে। যদি এনজিওজেনেসিস নিয়ন্ত্রণ করা একজন ব্যবহারকারীর নির্ভরযোগ্য হাতিয়ার হয়ে ওঠে, তাহলে ইস্কেমিক রোগ, চোখের রোগ বা এমনকি ক্যান্সারের উপস্থিতি ভবিষ্যতে আর ভীতিকর কিছু হবে না, বরং এগুলো চিকিৎসার মাধ্যমে নিরাময়যোগ্য রোগ হিসেবে বিবেচিত হবে।
ফাহিমা হাসান/ নিজস্ব প্রতিবেদক
তথ্যসূত্র: Systems biology of angiogenesis signalling: Computational models and omics, Advanced Science News