ওতযি দ্য আইসম্যান এখন পর্যন্ত পাওয়া সবচেয়ে প্রাচীন মমি। ১৯৯১ সালে দুইজন জার্মান পর্বতারোহী ওতযাল আল্পসে আরোহণ করছিলেন। এটি পর্বতের একটা সীমা যা অস্ট্রেলিয়া থেকে ইতালি পর্যন্ত বিস্তৃত। সেখানে তারা একটা মৃতদেহের সাথে হোঁচট খায় যেটা জমাট বাঁধা অবস্থায় ছিলো। বরফ দেহটিকে এমনভাবে সংরক্ষণ করে রেখেছিল যে তার দেহ এমনকি পোশাকেও পচন ধরেনি। বিজ্ঞানীরা তাকে বরফমানব ওতযি (ওতযি দ্য আইসম্যান) নামকরণ করেন।
বিজ্ঞানীরা হিসাব করে জানান যে, ওতযি প্রায় ৫০০০ বছর পূর্বে জীবিত ছিলেন। এটি তাকে এ যাবৎ পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া সবচেয়ে পুরাতন মমিতে পরিণত করে। গবেষকরা এখনও আল্পস পর্বতের সে মমি নিয়ে গবেষণা করছেন এবং হাজার বছর আগে তার দৈনন্দিন জীবন কেমন ছিল তার উত্তর বের করার চেষ্টা করছেন।
ওতযি কোন সময় বেঁচে ছিলেন?
আরোহীরা ওতযির মমিকৃত দেহটি খুঁজে পাওয়ার পর তৎক্ষনাৎ কর্তৃপক্ষকে জানান। অস্ট্রিয়ান পুলিশ ওতযির পরিধানকৃত ঘাসের ওভারকোটটি (বেশ লম্বা ঢিলে এক ধরণের কোট) লক্ষ্য করেছিল। এই পোশাকটি ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ পর্যন্ত সেখানকার স্থানীয়রা পরিধান করতেন। ফলে তারা ধরে নিয়েছিলো ওতজি আইসম্যান গত দুই শতাব্দীর কোনো এক সময় মারা গেছে। কিন্তু যখন বিজ্ঞানীরা গবেষণা শুরু করলেন, তারা বুঝতে পারলেন এর বয়স তাদের ধারণার চাইতে অনেক বেশি।
ওতযি আইসম্যান ৫০০০ বছর আগে নিওলিথিক যুগের তাম্র যুগে বসবাস করতো। একদল গবেষক ২০০৩ সালে সায়েন্স জার্নালে প্রকাশিত একটি গবেষণায় মমিটির হাড় এবং দাঁত পরীক্ষা করে দেখান যে, ওতযি তার পুরো জীবদ্দশা আল্পসের ৬০ কিলোমিটার সীমার মধ্যেই অতিবাহিত করে।
মৃত্যুর সময় ওতযির বয়স কত ছিলো?
বিজ্ঞানীরা ওতযি দ্য আইসম্যানের উপর সম্পূর্ণ-জিনোম সিকোয়েন্সিং পরিচালনা করে ২০১২ সালে ন্যাচার জার্নালে একটি গবেষণায় তাদের ফলাফল প্রকাশ করেছেন। ওতযির সম্ভবত বাদামি রংয়ের চোখ ছিল, সে করোনারি হার্টের রোগী ছিলেন এবং একইসাথে তার ল্যাক্টোজ ইনটোলারেন্সও ছিল। তার রক্ত ছিল O গ্রুপের এবং মৃত্যুর সময় তার বয়স ছিল সম্ভবত ৪০ থেকে ৫০ এর মধ্যে।
ওতযির স্বাস্থ্য কেমন ছিল?
বিজ্ঞানীরা ওতযির মৃত্যুর সময়কার স্বাস্থ্য সম্পর্কে অনেকটা জানেন কারণ তার অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলো বেশ ভালো অবস্থায় ছিলো। জীবদ্দশায় ওতযির আটটি পাঁজরের হাড় ভেঙেছিলো। তার মধ্যে কিছু কিছু মৃত্যুর আগে ঠিক হয়ে যায়। আর বাকিগুলো তখনো সম্পূর্ণ সুস্থ হয়নি। এছাড়াও তার অনেক শারীরিক সমস্যা ছিল। দাঁতের এনামেল ছিল ক্ষয়প্রাপ্ত। তার মাড়িরও সমস্যা ছিল।
ওতযি দ্য আইসম্যান কীভাবে মারা গিয়েছিলেন?
বিজ্ঞানীরা ওতযির মৃত্যু নিয়ে এখনও একমত হতে পারেননি। তার শরীরে পরিষ্কারভাবে দুটি ক্ষত ছিল। একদল গবেষক মনে করেন তাকে হত্যা করা হয়েছে। আরেক দলের মতে, তিনি তুষারঝড়ের শিকার হয়েছিলেন। তার পাকস্থলীর সামগ্রীক পরীক্ষা করে বিজ্ঞানীরা বুঝতে পেরেছেন যে কিভাবে সে পৃথিবীতে জীবিত অবস্থায় তার শেষের দিনগুলো কাটিয়েছিলো। মৃত্যুর আগে তিনি আল্পস পর্বতমালার উচ্চ অবস্থান থেকে নিম্ন উচ্চতায় চলে যান।
হাইকাররা তাকে যে জায়গাটিতে আবিষ্কার করেছিলো তা একসময় পাহাড়ের গিরিপথ ছিল। বিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করেন, ওতযি পাহাড়ের উপর থেকে নিচে যাওয়ার সময় দু’বার আক্রমণের শিকার হয়েছিলেন। তার হাতে ছুরিকাঘাত ছিল এবং কলারবোনও ভাঙ্গা ছিল যা তার বাম সাবক্ল্যাভিয়ান ধমনীতে মারাত্মকভাবে বিদ্ধ হতে পারতো।
ওতযির পরিধানকৃত পোশাক-আশাক কেমন ছিল?
ওটজি আইসম্যান আবিষ্কৃত হওয়ার আগে গবেষকরা কেবল ৩৩০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে লোকেরা কী পরিধান করতো তা অনুমান করতে পারতো। বরফের ফলে ওটজি জামাকাপড়সহ সংরক্ষিত ছিল। যার কারণে বিজ্ঞানীরা কাপড়ের উপাদানগুলো বিশ্লেষণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। CHIMIA-তে 2010 সালের একটি গবেষণায়, বিজ্ঞানীদের একটি দল তার পোশাকের লোমের প্রোটিন বিশ্লেষণ করে এবং জীবিত প্রাণীদের সাথে সেগুলোর তুলনা করে। যখন ওটজি মারা যান, তখন তার গায়ে ছিল বিভিন্ন ধরণের পশুর চামড়া থেকে তৈরি পোশাক।
মৃত্যর সময় তিনি ভালুকের চামড়া দিয়ে তৈরি একটি পশম ক্যাপ, সাথে একটি ভেড়ার লেগিংস (সরু প্যান্ট) এবং গবাদি পশুর চামড়া থেকে তৈরি মোকাসিন (এক ধরনের জুতো) পরিহিত অবস্থায় ছিলেন।
আরও বিশ্লেষণে দেখা যায়, ওতজি আইসম্যানের পোশাক পশুর চর্বি ব্যবহার করে একটি ট্যানিং প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে তৈরি করা হয়েছে। এটি গবেষকদের সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করায় যে ওতজি আইসম্যান ছিলেন একজন কৃষক এবং পশুপালকদের একটি উন্নত সমাজের সদস্য (শিকারী বা যাযাবর নয়)। তিনি বুনো ঘাস থেকে তৈরি একটি বহিরাগত কোট পড়েছিলেন। এই পোশাকের উপর ভিত্তি করে গবেষকরা বিশ্বাস করেন যে, তিনি সম্ভবত একজন কৃষক বা রাখাল ছিলেন, অভিজাত মর্যাদার কেউ ছিলেন না।
তার পেটের ভেতরের অবশিষ্টাংশগুলো বিশ্লেষণে দেখা গিয়েছে, তিনি বেশ ভালো খাবার খেতেন। প্রধানত মাংস এবং শাকসবজি।
ওতজি দ্য আইসম্যান কি প্রাচীনতম ট্যাটু করা মমি?
ওতজি দ্য আইসম্যান এর শরীরের 19 টি জায়গায় 61 টি ট্যাটু রয়েছে। বর্তমানে তাকে প্রাচীনতম ট্যাটু করা মমি হিসাবে বিবেচনা করা হয়। উল্কিগুলোর প্রতীকী বা আধ্যাত্মিক অর্থ থাকতে পারে। তার দেহাবশেষের বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ থেকে জানা যায়, তার বাত এবং সেইসাথে একটি হুইপওয়ার্ম এর সংক্রমণ হয়েছিল।
মজার বিষয় হলো, তার শরীরে ৬১টি ট্যাটুর মধ্যে ৮০% ট্যাটু চীনের চিকিৎসা শাস্ত্রের আকুপাংচারে ব্যবহৃত চাপের পয়েন্টের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। অন্যান্য 20% আকুপাংচার স্পটগুলোর উপর বা কাছাকাছি অবস্থিত যা অন্যান্য দীর্ঘস্থায়ী স্বাস্থ্য সমস্যাগুলোর নিরাময়ের সাথে যুক্ত। তাই বিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করেন যে তার ট্যাটুগুলো ঔষধি ছিল এবং প্রতিরোধমূলক বা নিরাময়মূলক উদ্দেশ্যে তৈরি করা হয়েছিল।
এসব ট্যাটু তৈরি করতে হাড় বা ইস্পাতের সুই, ল্যাম্পব্লাক, প্রস্রাব (urine) এবং সীল মাছের তেল ব্যবহার করা হতো। কিছু অঞ্চলে গ্রাফাইট এবং উদ্ভিদের রসও ব্যবহার করা হতো। প্রায়শই, উল্কিগুলোকে অ্যাপোট্রপিক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী বলে বিশ্বাস করা হতো। ট্যাটুগুলো দেখে গবেষকরা বুঝতে পারছেন যে আল্পসে বসবাসকারী প্রাচীন ইউরোপীয়রাও একধরনের আকুপাংচার অনুশীলন করতো।
বিজ্ঞানীরা ওতযি দ্য আইসম্যানের দেহ, তার ট্যাটু, পোশাক এবং সরঞ্জামগুলো নিয়ে ক্রমাগত অধ্যয়ন চালিয়ে যাচ্ছেন। যদিও তার জীবন সম্পর্কে সমস্ত রহস্যের সমাধান বের করা হয়তো কখনও সম্ভব হবে না।
মোহাম্মদ রনি / নিজস্ব প্রতিবেদক
তথ্যসূত্র: সায়েন্স এলার্ট, দ্য গার্ডিয়ান, ডিসকভার ম্যাগাজিন, সায়েন্টিফিক আমেরিকান, আর্ট পাবলিকা