মাইক্রোওয়েভ ওভেন মানুষের দৈনন্দিন জীবনে বহুল ব্যবহৃত একটি ইলেকট্রনিক ডিভাইস। কিন্তু ভুল পদ্ধতিতে এর ব্যবহার হতে পারে আমাদের স্বাস্থ্যঝুঁকির কারণ। সাম্প্রতিককালে গবেষণায় দেখা গেছে, প্লাস্টিকের কন্টেইনার বা পাত্রে রেখে যদি খাবার মাইক্রোওয়েভ ওভেন এ গরম করা হয় তাহলে খাবারের সাথে ঝুঁকিপূর্ণ মাত্রায় মাইক্রোপ্লাস্টিক আর ন্যানোপ্লাস্টিক মিশে যায়, যা শিশু এবং প্রাপ্তবয়স্ক উভয়ের জন্যই ক্ষতিকর।
প্রশ্ন আসতে পারে মাইক্রোপ্লাস্টিক আর ন্যানোপ্লাস্টিক কি জিনিস?
সংক্ষেপে বললে এরা হলো খুব ক্ষুদ্র প্লাস্টিক কণা যাদের খালি চোখে দেখা যায়না। কিন্তু এরা কোনভাবে মানুষের শরীরে প্রবেশ করলে তা মানবদেহে নানা ধরণের সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে।
“Environmental Science and Technology” জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখা যায়, প্লাস্টিকের পাত্রে রেখে যদি মাইক্রোওয়েভ ওভেন এ মাত্র ৩ মিনিটের জন্য খাবার গরম করা হয় তাহলে পাত্রের প্রতি বর্গ সেন্টিমিটার জায়গা থেকে প্রায় ৪০ লাখ মাইক্রোপ্লাস্টিক খাবারের সাথে মিশে যায় আর ন্যানোপ্লাস্টিকের পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ২০০ কোটিরও বেশি! এই বিপুল পরিমাণে প্লাস্টিক কণা আপনার দেহে প্রবেশ করার আশঙ্কা থাকে যখন আপনি প্রতিবার প্লাস্টিকের পাত্রে গরম করা খাবার গ্রহণ করেন।
টেস্টটিতে দৈনন্দিন জীবনে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত পলিপ্রোপিলিন (polypropylene) এর কৌটা আর পলিথিলিনের (polyethylene) ব্যাগে অ-আয়নিত পানি (De-ionized water) এবং ৩% এসিটিক এসিড (সিরকা) রেখে মাইক্রোওয়েভ ওভেনে গরম করা হয়।
উপাদান ২টি মূলত তরল খাবার আর অম্লীয় খাবার (নানা দুগ্ধজাত খাদ্যদ্রব্য, শাকসবজি, ফলমূল ইত্যাদি) গরম করলে কী কী ঘটনা ঘটতে পারে তা বুঝতে ব্যবহার করা হয়। পলিপ্রোপিলিন আর পলিথিন ব্যাগ থেকে নির্গত মাইক্রো ও ন্যানোপ্লাস্টিক এর পরিমাণ বিশ্লেষণ করলে দেয়া যায়, পলিথিনের ব্যাগ থেকে হওয়া প্লাস্টিক দূষণের মাত্রা প্লাস্টিকের কৌটা থেকে প্রায় ১০০০ গুণ বেশি।
পাত্র থেকে কী পরিমাণ প্লাস্টিক নির্গত হবে তা কিছু জিনিসের উপর নির্ভর করে। তার মধ্যে একটি হলো পাত্রের ধরণ। প্লাস্টিকের পাত্রকে মজবুত, দীর্ঘস্থায়ী আর নমনীয় করতে তার সাথে Bisphenol-A (BPA) এবং Phthalates নামের ২ ধরনের রাসায়নিক পদার্থ মিশ্রিত করা হয়। এই রাসায়নিক পদার্থ দিয়ে তৈরি এমন পাত্রে রেখে যদি খাবার গরম করা হয় তাহলে সহজেই এই পদার্থ গুলো খাবারের সাথে মিশে যায়। BPA এবং Phthalates মানবশরীরের জন্য খুবই ক্ষতিকর কারণ এরা দেহের স্বাভাবিক হরমোন ক্ষরণে বাধা সৃষ্টি করে।
হরমোন বিশেষজ্ঞদের মতে, এইসব পদার্থ দেহে প্রবেশ করলে তা বন্ধ্যাত্ব, থাইরয়েডের রোগ, ব্লাড ক্যান্সার, প্রস্টেট ক্যান্সার এর মতো প্রাণঘাতী রোগ তৈরির সক্ষমতা রাখে।
অপর একটি গবেষণা থেকে অনুমান করা হচ্ছে Phthalates এর কারণে প্রতিবছর প্রায় এক লাখ মানুষ অকালে মৃত্যুবরণ করছেন। যাদের দেহে অতিমাত্রায় Phthalates জমা হয়েছে তারা নানা ধরনের কার্ডিওভাসকুলার রোগের উচ্চঝুঁকিতে রয়েছেন।
গবেষণাটি থেকে আরও জানা যায়, শিশুদের জন্য তৈরিকৃত দুগ্ধজাত খাদ্যদ্রব্য প্লাস্টিক এর পাত্রে বা পলিথিনের প্যাকেটে রেখে গরম করার ফলে শিশুরা সবচেয়ে বেশি মাত্রায় প্লাস্টিক দূষণের স্বীকার হচ্ছে এবং শিশুরাই মূলত প্লাস্টিক দূষণের জন্য সবচেয়ে বেশি স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছে। দীর্ঘদিন শিশুদের ভুল উপায়ে ওভেনে গরম করা খাবার খাওয়ানোর ফলে এসব প্লাস্টিক কণা তাদের দেহে জমা হয় এবং অতিমাত্রায় এসব পদার্থের উপিস্থিতি শিশুমৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।
মানবদেহে এর ক্ষতিকর প্রভাব ভালোভাবে বুঝার জন্য কিছু কিডনি কোষকে এই মাইক্রোপ্লাস্টিকের সংস্পর্শে আনার পর দেখা যায়, এর কারণে ২৩% কিডনি কোষের মৃত্যু ঘটেছে। যা থেকে ধারণা করা হচ্ছে কিডনি কোষের মাইক্রো ও ন্যানোপ্লাস্টিক দ্বারা আক্রান্ত ও ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি।
এখন মনে নিশ্চয়ই প্রশ্ন জাগছে এর থেকে বাচাঁর জন্য কী কী করা যেতে পারে?
সবচেয়ে উত্তম উপায় হলো কোন ধরনের প্লাস্টিকের পাত্রেই খাবার রেখে তা মাইক্রোওয়েভ ওভেন এ গরম না করা। বরং সবসময় কাঁচের পাত্রে রেখে খাবার গরম করা উচিত। না হয় ওভেনে ব্যবহার উপযোগী porcelain এর পাত্র ব্যবহার করা যেতে পারে। তাছাড়া বিশেষজ্ঞদের মতে খাবার সংরক্ষণ করার ক্ষেত্রেও BPA এবং Phthalates যুক্ত প্লাস্টিকের পাত্র ব্যবহার করা উচিত নয়। যাতে করে খাবারের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায়।
কেবল গরম করার দ্বারাই নয়, উচ্চ তাপে গরম করা খাবার প্লাস্টিকের পাত্রে রাখলেও একই ধরণের ঘটনা ঘটার আশংকা থাকে। তাই গরম খাবার যেন “গরম খাবার সংরক্ষণ উপযোগী” নয় এমন প্লাস্টিকের পাত্রে সংরক্ষণ করা না হয় সে বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। পাশাপাশি গরম পানি ফ্লাস্ক ব্যতীত কোনো প্লাস্টিকের গ্লাসে করে খাওয়া বা রাখাও বুদ্ধিমানের কাজ হবেনা!
তথ্যসূত্র: শার্প.কম, সাইন্স ডাইরেক্ট, দি টাইমস অব ইন্ডিয়া
লাবিব সাফওয়ান/ নিজস্ব প্রতিবেদক